Tuesday, July 28, 2020

র্স্পশের প্রবাহিত ঝরণা গল্প (রোকেয়া ইসলাম)



র্স্পশের প্রবাহিত ঝরণা
রোকেয়া ইসলাম

দুহাতে বাঁধা লাল হলুদ আর সবুজ ফিতা। প্রথমে সবুজ শেষে লাল মাঝে হলুদ। পি, টি স্যার ওদের এই ফিতা বাঁধা হাত বিশেষ ভঙ্গিতে নাড়াতে শিখিয়েছেন। 
বিন্দু বাসিনী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা লেখা পড়ায় যেমন চৌকস তেমনি পিটি প্যাযেজেও দক্ষ। গত পনরদিন পি,টি স্যার নিজে যেমন পরিশ্রম করে বহু ঘাস ছাত্রীদের ঝরিয়ে তবেই আজকের দিনের জন্য তৈরী করেছেন। এই শ্রমসাধ্য কর্ম ওরা খুবই আনন্দের সাথে করেছে। ওরা দাঁড়াবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সামনে। তিনি আসছেন তার বাংলাদেশে। তিনি আসছেন মুক্তি যুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকার জেলা টাঙ্গাইলে। 
স্কুলের স্যাররা কঠিন শব্দ গুলো সহজ করে ওদের বুঝিয়েছে। জোনাকি অবশ্য আগেই এসব শুনেছে ওর বাবার কাছ থেকে। 
হঠাৎই জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু ধবনিতে চারপাশ কেঁপে উঠে। সচকিত হয়ে সামনে তাকায় জোনাকি, কালো জিপে সফেদ সাদা পাজামা পাঞ্জাবী ছয় বোতামের কালো মুজিব কোট পরিহিত দাঁড়িয়ে আছেন আকাশের দরজা খুলে নেমে আসা এক দেবদূত। আকাশ ছুঁয়ে আছে তার মাথা। দৃষ্টি সোজা সামনে দিকে। খোলা জিপ সামনের দিকে এগুচ্ছে ওদের স্কুলের ছোট ছোট মেয়েরা টাঙ্গাইল তাঁতের জুড়ে শাড়ী পরে হাতে কুলো তাতে গাঁদা ফুলের পাপড়ি সেগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে পথ জুড়ে। কন্ঠে বরণ সঙ্গীত। বরণ সঙ্গীতের সাথে সাথে জিপ এগিয়ে আসছে। বরণ সঙ্গীত থেমে যেতেই খোলা জিপ ওদের দলকে ছুঁইয়ে ফেলে॥ ওরা হাতের লাল হলুদ সবুজ ফিতা নাড়ছে বিশেষ ভঙ্গিতে মুখে থাকছে। 
“শুভেচ্ছা” স্বাগতম শ্লোগান। স্যার ওদের বাতাসের উজানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বাতাসে ফিতাগুলো উড়ে উপরে দোল খাচ্ছে তাতে রোদের আলো পড়ে কি চমৎকার ঝিলিক দিচ্ছে, বর্ণিল হয়ে দোল খেতে খেতে ফিতাগুলোও যেন আনন্দে সুর তুলছে “শুভেচ্ছা” স্বাগতম। 
জোনাকি তাঁকিয়ে দেখে গাড়িটা তার সামনে। খোলা জিপে দাড়িয়ে আছেন তিনি। তার চোখের প্রথম দৃষ্টি জোনাকির কিশোরী চোখে। কি উজ্জল চাহনি ঠিক যেন, কিছুক্ষন আগের তীব্র রোদের ঝলকানির সবুজ লাল হলুদ ফিতার উজ্জল আনন্দের মত! জোনাকি হাত নাড়তে ভুলে যায়। শুভেচ্ছা স্বাগতম বলতেও ভুলে যায়। সমুদ্রের মতো একজোড়া চোখের দিকে তাকিয়ে পরম নির্ভরতায় হাত বাড়িয়ে দেয়। ওকে অবাক করে নিচু হয়ে তিনিও হাত বাড়িয়ে দেন। খুব সামান্য সময়ের জন্য। এর মধ্যেই দুপাশ ভেঙ্গে চুরে স্কুলের ছাত্রীরা আসছে। পি,টি স্যার বাঁশি ফু দিয়ে লাইন ঠিক করার চেষ্টা করছে। পুলিশের বাঁশি বাজছে ঘনঘন। গগণ বিদারী শ্লোগান, এর মধ্যেই এগিয়ে যায় গাড়ি। কিশোরী কণ্যাটি পিতারও অধিক পিতার হস্ত র্স্পশে বিহবল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে খানিকটা সময়!!
একাত্তরের দিন গুলোতে মায়ের পাশে জায়নামছে গিয়ে দাঁড়াতো নামতিই জায়নামাতে নামই শেষে দেশ মুক্তিযোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধুর জন্য দোয়া করতো। সেই যে পত্রিকার পাতায় দেখা বঙ্গবন্ধু কবে কখন জোনাকির এতো আপন হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারে নাই জোনাকি। সেই আপনজন আত্নার স্বজন জোনাকির হাত র্স্পশ করছে। ওর ছোট জীবনে এর চেয়ে বিশাল প্রাপ্তি আর কি হতে পারে!!
ডান হাত মুঠো দাঁড়িয়ে থাকে জোনাকি। পিটি স্যার বাঁশি ফুঁ দিয়ে ওদের স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জোনাকি জানে পিটি স্যার আজ ওকে খুব বকবে। কেন ও হাত বাড়িয়ে দিল তাতে লাইন ভেঙ্গে গেল। বকুক খুব বকুক ওকে। রোদে দাঁড় রাখুক খোলা। দেখুক ক্লাশে বসে সব ছাত্রীরা জানালা দিয়ে, কিচ্ছু আসে যায় না তাতে জোনাকির। আজ জোনাকি অর্জন করেছে ওর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বঙ্গবন্ধুর স্পর্শ, পিতার স্পর্শ, জাতির পিতার স্পর্শ!!!
জোনাকি স্কুলে ফিরে যায় না। ও চলে যায় বিন্দু বাসিনী বালক বিদ্যালয়ের একতলা দালানের ছাদে। অস্ত্র সমার্পণ অনুষ্ঠানের অতিথীতে গিজ গিজ করছে পুরো ছাদ। মাঠের এক কোনে বড়সড় ষ্টেজ। পুরো মাঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের কাঁধে নয়মাসের সর্বক্ষণের সঙ্গী অস্ত্র। মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্বকালীন নেতা বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে তার নয় মাসের,অস্ত্র সমাপর্ণ করে নয় মাসের রাখলেন সংগ্রাম শেষে উঠে দাঁড়ালেন সাফল্যের সাথে। একে একে সকল মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে গিয়ে মাঠের কোণে তাদের অস্ত্র ঘটাঘট করে রেখে স্তুপ করে ফেললেন। 
জোনাকি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছে। আজ ওর কাছে পরম পাওয়া পরশ পাথর স্পর্শ। ওর বুকে বাজছে। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি সেই পরম পাওয়া র্স্পশ সম্বল করেই কেটে গেছে দীর্ঘকাল। কত অঘটন ঘটল, কত ঘটনা ঘটলো। কিশোরী জোনাকিও আজ ষাট বছর বয়েসী একজন পোড় খাওয়া মানুষ কত পরিবর্তন তবুও জোনাকির বুকের গভীরে রাখা গোপন আর্দশের কোন পরির্বতন হলো না। 
জোনাকির চোখ দিয়ে পানি পড়ে কপোল ভিজিয়ে দিতেই টের পায় ও দাঁড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু যাদুঘরের তৃতীয় তলায়, খোলা ছাঁদে। পাশে শেখ কামালের শোবার ঘর। 
চোখ মোছার জন্য ডান হাতটা তুলতে গিয়েই বুঝতে পারে ওর হাত ধরে আছে ওর নাতনী রূপন্তী। 
-দাদী তুমি এখানে এলে শুধু কাঁদো আবার কেন আসো তাহলে। 
নাতনীর প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে আগে ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে চোখ মোছে ধীরে সুস্থে তাকায় নাতনীর দিকে। -পাল্টা প্রশ্ন করে রূপন্তীকে। 
-এখানে আসতে তোমার ভাললাগে। 
-ভাল না লাগলে কি তোমার সাথে প্রায়ই এখানে আসি। 
-বলতো এখানে এলে সবচেয়ে কি ভাল লাগে তোমার। 
-বাড়ীর সামনের ঐ কালো পাথরের মানুষটাকে আমার খুব ভাললাগে। তাইতো প্রতিবার আসার সময় তোমার গাছ থেকে লাল গোলাপ এনে দেই দাদী। 
-তুমি জানো উনি কে?
-হ্যা খুব জানি উনি হলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। 
-রূপন্তীর ভালালাগায় শ্রদ্ধার গোলাপ অর্পণ করা, সঠিক পরিচয় বলা, দেখে জোনাকি আপ্লুত হয়ে যায়। সেই পরম পরশ পাওয়া ডান হাতটার স্পর্শ বুঝি প্রবাহিত হচ্ছে প্রজম্ম থেকে প্রজম্ম। 
-চল দাদী নিচে যাই উনার কাছে যাই। বঙ্গবন্ধুর ভার্স্কয়ের সামনে দাঁড়ায় দাদী নাতনী। পাদদেশ স্পর্শ করে জোঁনাকি। 
-এই স্পর্শের নাম কি হতে পারে জানে না। তবে এটুকু জানে এটা হল বিশ^াস আদর্শ আর সম্মান। হৃদয়ের গভীরে বয়ে চলে নিরবধি। প্রজম্ম থেকে প্রজম্ম। জোনাকি থেকে রূপন্ত্রী। থেকে আরো অনেক। আরো বহুদূর!!...


0 comments:

Post a Comment