মুক্তিযুদ্ধের গল্প
মুক্তিযুদ্ধ ও একজন আনা
আমেনা আফতাব
আনার বাবা টাটা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। ও এবং ওর চার ভাই বোনের জন্ম তাই পশ্চিম বঙ্গে। এক সময় টাটার আর্থিক মন্দা শুরু হলে স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে হয় আনার বাবাকে। তখন ছেলে মেয়ে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন তিনি। আনারা তখন মোটামুটি বড় হয়েছে। দু’ভাই দু’বোনের মধ্যে আনা সবার ছোট। আনার বাবা টাকাকড়ি ভালোই কামাই করতেন। আর্থিক দিক দিয়ে স্বচ্ছলতা থাকা সত্বেও শৈশবটা তাদের সুখকর ছিলো না। ছোট বেলাতেই মা মারা যান। ভাই বোন আনার চেয়ে খুব বড় নয়। আনাকে কে সামলাবে। বাবা আবার বিয়ে করলেন মার ছোট বোনকে। বাবা ভেবেছিলেন নিজের খালা মায়ের অভাব পূরণ করতে পারবেন। সৎ মা না হয়ে একজন মমতাময়ী মা হবেন। বাস্তবে হলো তার ঠিক উল্টো। অত্যন্ত জেদী আর রুক্ষ্ম স্বভাবের খালা সব সময় কড়া শাসনে রাখতেন আনাদেরকে। একটু ছুতো পেলেই মারধর করতেন। আনার উপরেই বেশি মার পড়তো। ভয়ে কুকড়ে থাকতো চার ভাই বোন কখন যে কার উপর সৎ মার ডাণ্ডা পড়ে। বাবা অনেক চেষ্টা করলেন তার স্বভাব পরিবর্তন করাতে। বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে ছেলে মেয়ের দরদী করতে চাইলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। তিনি স্বামীর খেদমত করতে চান কিন্তু ছেলে মেয়ের ঝামেলা সহ্য করতে নারাজ। তার অত্যাচারের মাত্রা দিনদিন বাড়তে থাকলে বাবা নিরুপায় হয়ে একদিন তালাক দিলেন দ্বিতীয় স্ত্রীকে। নিজেই তুলে নিলেন সন্তানদের দায়িত্বভার। এজন্য তাকে কঠিন পরিশ্রম করতে হতো। ভাই বোনদের মাঝে আনা ছিলো একেবারে নিরীহ। না ছিলো তার কোনো চাহিদা, না রাগ, না জেদ। কিছুই না। তাকে যেভাবে চালানো যেতো সে চলতো। পূর্ব পাকিস্তানে আসার পর আনার বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেলো। বড় ভাই উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করে বিলেতে গিয়ে পড়তে চান। বাবা তাতে অমত না করে টাকা পয়সা দিয়ে পাঠিয়ে দেন। থাকলো ছোট ভাই আর আনা। দু’জনে খুব হৃদ্যতা। হঠাৎ একদিন বাবা মারা গেলেন। সংসারটা কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেলো। বড় বোন ছোট ভাই আর আনাকে নিয়ে চিন্তায় পড়লেন। বড় বোনই একটা ছেলে দেখলেন আনার জন্য। খোঁজ খবর নিয়ে ভাই বোন মিলে তাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন।
বিয়ের পর সুখে পড়লো আনা। ভালো মানুষ তার স্বামী। রোজগার ভালো। আনাকে কিছুই চাইতে হয় না। না চাইতেই সব এনে হাজির করে। আনার প্রয়োজনটা কী করে যেনো বুঝে নেয়। আনার কাছে এটা একটা ম্যাজিকের মতো মনে হয়।
আনার চার ভাইবোন খুব সুন্দর ছিলো তবে আনা ছিলো বেশি সুন্দর। ফর্সা মুখে গোলাপী আঁচ, মাথাভর্তি কালো চুল, নাকমুখ খাড়া, সুন্দর হওয়ার জন্য যতোটা লম্বা হওয়া দরকার ঠিক ততোটাই লম্বা শরীর স্বাস্থ্যও সে রকম। আনার মেয়েরাও ঠিক তারই মতোন। পরপর চার কন্যা সন্তানের মা হলো আনা।
আনার সংসারে শ্বশুর শাশুড়ি ছিলেন না। কিন্তু একজন অবিবাহিত ভাসুর ছিলেন। তাকে পরিবারের সদস্য না বলে প্রধান বলা চলে। তিনিও রোজগারপাতি ভালো করতেন। ট্রাকের ব্যবসা ছিলো। অনেকগুলো ট্রাকের মালিক। সীমান্তে মাল আনা নেয়ার কাজে ব্যবহার হতো ট্রাকগুলো। আনার স্বামী তাকে অভিভাবক হিসেবেই দেখতেন। তিনি যেটা আদেশ করেন তা পালন করতে সব সময় এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সংসার এক রকম তার নির্দেশেই চলতো। আনার জন্য সেটা অহিতকর কিছু ছিলো না। কিন্তু অহিতকর যেটা ছিলো সেটা লজ্জায় এবং ভয়ে স্বামীকে কোনদিন বলতে পারেনি আনা। তার মনে হতো স্বামী তার বড় ভাইকে কিছুতেই অবিশ্বাস করবে না। বরঞ্চ আনাকেই সন্দেহ করবে। সেটা হলো আনার প্রতি কু-দৃষ্টি। আনা সেটাকে সহজভাবে দেখার খুব চেষ্টা করে। সে ভাবতে চায়, তার মুসল্লী ভাসুর বিয়ে করেননি বলে মেয়ে মানুষদের প্রতি কিছুটা কৌতূহলী। কী কারণে যে তিনি বিয়ে করেননি তা নিয়ে আনা কোনো কৌতূহল দেখায় না। জানতেও চায় না কারো কাছে।
আনার বাবা টাটা ছেড়ে আসার সময় টাকা পয়সা ভালোই এনেছিলেন সঙ্গে করে। বড় ছেলেকে বিদেশ যেতে তার অংশের টাকা দিলেন বড় বোনেরটা দিলেন বিয়ের সময়। আবার আনার জন্য রাখা টাকা সেও পেলো বিয়ের সময়। আর বাবার করা শহরের বাড়িটা দিলেন ছোট ছেলেকে। বাবা এভাবেই পরিষ্কার ভাগ বাটোয়ারা করে রেখে যান তার সম্পদ।
আনার বড় ভাই পড়াশুনা শেষ করে আর দেশে ফিরেন না, খবর পাওয়া যায় তিনি মেম সাহেব বিয়ে করে ওখানেই স্থায়ী হয়েছেন। সেই মেম সাহেবের নাকি অনেক টাকা পয়সা কিন্তু বয়সে নাকি আনার ভাইয়ার চেয়ে অনেক বড়। লোকজন শুনে বলে, বুড়ি বিয়ে করেছেন। ঐ দেশে বুড়িরা এ রকম সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে যুবকদের বিয়ে করে। বিয়ের পর থেকে ভাইবোনের সাথে আর যোগাযোগ রাখেন না আনার ভাইয়া। সেই বুড়ি মেম সাহেব নাকি দেশের কোনো লোক গেলে ভাইয়ার সাথে দেখা করতে দিতো না। তার ভয় ছিলো তারা যদি শিখিয়ে পড়িয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভাইয়াকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তাই দরজার বাইরে সাইনবোর্ড টানিয়ে রেখেছিলো- ঘড় বহঃৎু ভড়ৎ হধঃরাব. বড় ভাইয়ের ব্যাপারটা আনার ছোট ভাইর মনে খুব এ্যাফেক্ট করে। ছোট ভাই বলতো বাবার টাকা পয়সাগুলো একেবারে জলে গেলো। মানুষ না হয়ে অমানুষ হয়ে গেলো আমাদের ভাইয়া। সেই থেকে ছোট ভাই বাউন্ডুলে স্বভাবের হয়ে গেলো। পড়াশুনায় মনোযোগ নেই। কিন্তু পরোপকার করে বেড়াতো। রাজনীতি করাও শুরু করলো। এক সময় পড়াশুনা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে বিদ্যুৎ অফিসে ছোটো খাটো একটা চাকটি নিলো। ট্রেড ইউনিয়নের নেতাও হলো।
আনার ছোট ভাইকে আর ঘর সংসারী করা গেলো না। এসবে বিমুখ সে। আনা আর তার বোন মিলে তাকে বন্ধনে জড়াবার জন্য অনেক করে বোঝালো। সে রাজি হয় না। ট্রেড ইউনিয়নের নেতার অনেক কাজ। সে সেই কাজ নিয়েই থাকতে চায়। কিন্তু যে কোনো ব্যাপারে আনার ডাক সে উপেক্ষা করতে পারে না। আনার স্বামী দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। এ কথা শুনামাত্র সে ছুটে যায়। গিয়ে দেখে আনার ভাসুর তার মতো করে চিকিৎসা পত্রের ব্যবস্থা করেছেন। আনার ভাসুরকে সে মিয়াসাব ডাকে। মিয়াসাবের কবিরাজি ব্যবস্থা তার মনপুত হয় না। সে আনাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসে তার শহরের বাসায়। মিয়াসাব আপত্তি তুলেন। সে শোনে না। আনাদের বাড়ি নদীর ওপারে। ওখানে চিকিৎসার সুব্যবস্থা নাই। মিয়াসাব বলেন-
: কবিরাজ তো আছে।
সে বলে-
: কবিরাজে এ রোগ সারবে না।
মিয়াসাব একটু আস্তে করে বলেন-
: বেয়াদব ...
সে না শোনার ভান করে চলে আসে।
ভালো ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা শুরু হয় আনার স্বামীর। রোগের নাম ক্যান্সার। যকৃতে ক্যান্সার। আনা হতবিহবল হয়ে পড়ে।
ভাই তাকে শান্তনা দেয়-
: আমি আছি না, তোর কোনো চিন্তা নেই। সব সেরে যাবে। আনা তার সতের ভরি সোনা, স্বামীর সঞ্চিত অর্থ ভাইর হাতে তোলে দিতে চায়। ভাই বলে-
: এখন রাখ। দরকার লাগলে নেব। আমার কাছে যা আছে আগে তাই দিয়ে চলুক।
আনা তো জানে তার ভাইয়ের সঞ্চয় তেমন কিছু নেই। এই বাড়িটা ছাড়া। কিন্তু মনের দিক থেকে তার ভাইটা অনেক বড়।
ভাইর বাসায় এসে আনা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ভাসুরের কুদৃষ্টিটা এখানে তো তার উপর পড়বে না আর। স্বামীর অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে বেশ বাড়াবাড়ি শুরু করেছিলো লোকটা। ভাইয়ের কাছে ইশারা ইঙ্গিতে কিছু বলতে চায় আনা। বারেবারে লজ্জায় তার সব তালগোল পাকিয়ে যায়। সে শুধু বলে-
: তার ভাসুরের স্বভাব চরিত্র ভালো নয়।
ভাই যেনো অশুভ কিছুর আভাস পেয়ে সচকিত হয়ে উঠে। বারবার বলে-
: তোকে কোনো অপমান করেছে?
আনা ইতস্তত করে, বলে-
: না করেনি, তবে ...
: তবে কী? কিছু করলে জানে রাখবো না মিয়াসাবকে। খুলে বল।
আনা শুধু বলে-
: আমার ভয় করে।
: কিসের ভয় ! আমি তোর পাশে। সব সময় আছি। তুই নির্ভয়ে থাক এখানে। ওখানে আর ফিরে যাওয়ার দরকার নেই।
এমন এক সময় যুদ্ধ বাঁধে। স্বাধীনতার যুদ্ধ। আনার ভাসুরেরই যেনো সুযোগ করে দিলো যুদ্ধ। তার ভাইটাকে জানে মারার সুযোগ। শুরুতেই আমার ভাইকে ধরতে মিলিটারি ঢুকলো তাদের ঘরে। দরজায় কড়া নাড়লো মধ্য রাতে। আনার মন বললো- ‘মিলিটারি এসেছে। এতো রাতে আর কেউ আসার নেই। চারদিকে ধরপাকড়, ভাই ট্রেড ইউনিয়নের নেতা। ভাইকে ধরানোর পেছনে তার ভাসুরেরই হাত থাকবে’। আনা দরজা খোলার আগে ভাইকে সাবধান করতে যায়। দেখে ভাই ঘরে নাই। ছাদের কার্নিশ দিয়েই বোধহয় নেমে পেছনের জঙ্গলে আত্মগোপন করেছে। আনার বুক থেকে একটা ভারী বোঝা নামে।
মিলিটারি দরজায় লাথি মারছে। সে মাথায় কাপড় তোলে। প্রায় পুরো মুখটাই ঢেকে দরজা খোলে। একজন সৈন্য জানতে চায়-
: দৌলা কোন হ্যায়?
আনা আস্তে বলে-
: বাড়িতে নেই।
বন্দুকের বাট দিয়ে আনার মুখের কাপড় সরায় একজন। আরেকজন বলে-
: খুবসুরত আওরত হ্যায়।
আনা চোখ নামিয়ে খতমে ইউনুস পড়তে থাকে। ততক্ষণে তার চার মেয়ের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। তারা মিলিটারি, বন্দুক ঘরের ভেতরে এগুলো দেখে কাঁদতে শুরু করেছে। আনার মুখের সামনে বন্দুক ধরে রেখে একই ব্যক্তি এবার বলে-
: সাচ বাত।
আনার সামনে আজরাইল। ভয় পেয়ে লাভ কী? সে আবার বলে-
: ভাই ঘরে নাই।
বন্দুক সরিয়ে নেয় সৈন্যটা। বাড়িটা তন্ন তন্ন করে খোঁজে দেখে। স্টিলের আলমারির চাবি টেবিলের উপরেই ফেলে রেখেছিলো আনা। আলমিরা খুলে খুশি হয়ে উঠে মিলিটারিরা। আনার সতের ভরি স্বর্ণ আর টাকা পয়সা কিছুই রাখে না। সব তুলে নেয়। নিজেদের মধ্যে স্ফূর্তি করে কী সব বলাবলি করে। আনার স্বামী বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন সব দেখে। হঠাৎ গোঙানি শোনা যায়। মুখটা এক পাশে বাঁকা হয়ে যায়। ‘হার্টফেল’ বলে উঠে একজন সৈন্য। ঠিক যেনো মজা করার মতো। কী মনে করে একে একে বেরিয়ে যায় তারা।
আনা ছুটে গিয়ে স্বামীর মাথায় হাত দেয়। নাম ধরে ডাকতে থাকে। কোনো সাড়া নেই। পায়ে হাত দেয়। ঠাণ্ডা হতে শুরু করেছে পা। মৃত্যুর শীতল ছোঁয়া এখন তার স্বামীর নিথর দেহে। দুঃসময়ে ছেড়ে গেলো তাকে। সে কাছে থেকেও কলমা শুনাতে পারলো না। মাফ নিতে পারলো না স্বামীর কাছ থেকে। কী হতভাগ্য আনা। একটু আলোর মুখ দেখেছিলো। আবার আঁধার নেমে এলো তার জীবনে। সবদিকে নিঃস্ব হয়ে গেলো সে। স্বর্ণ, অর্থ গেলো, স্বামী গেলেন। আর ভাই-ভাইটা বেঁচে থাকতে পারবে কিনা পাঞ্জাবি সৈন্যদের হাত থেকে সে জানে না।
স্বামীর লাশের পাশে বসে আনা কাঁদছে। তার সন্তানেরা কাঁদছে। আর ঠিক তখনই পরম শুভাকাক্সক্ষী হয়ে তার ভাসুর ঢুকলেন ঘরে। কে তাকে খবর দিলো। এতো রাতে তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। এবার আনা পুরোপুরি বিশ্বাস করলো তার মুসলিম লীগার ভাসুরই মিলিটারি ঢুকিয়েছিলো তাদের ঘরে। তার ভাইকে শেষ করতে। বুঝলেও তার আর করার কিছুই নেই।
কিছুক্ষণ ভাইয়ের লাশ ছুঁয়ে মায়াকান্না কাঁদলেন ভাসুর। আনার ভাইয়ের নাম ধরে গালাগালি করলেন। তার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য তাকেই দায়ী করলেন। আনার মেয়েদের মাথায় হাত দিয়ে শপথ করলেন, এদের ভালোর জন্য যা যা করার দরকার সব করবেন। লাশ দাফন হলো গ্রামের বাড়ীতে। আনাও সাদা থান পড়লো। লাশের সাথেই আনাদের চলে আসতে হলো তার ভাইয়ের বাসা ছেড়ে। ভাসুর রসিয়ে রসিয়ে বললেন-
: তোমার ভাই ভেজাল মানুষ। দেশের শত্রু। ছোড়া জয়বাংলা বলে পাকিস্তানকে ডুবাতে চায়। মিলিটারিরা একবার তাকে ধরতে পারেনি। ভেবো না ছেড়ে দেবে। আমার ভাস্তিদেরকে নিয়ে ওখানে থাকা আর নিরাপদ নয় তোমার। আনা যেনো একটা শুকনো লেবুর খোসা। নিজের কোনো মতামত জানায় না। দিন দুনিয়ার মালিক যিনি তিনিই তো তার ডানা ছেটে দিয়েছেন। তার আর মুক্তির উপায় নেই। সে বুঝতে পারছে। মনে মনে শুধু ভাইটার জন্য প্রার্থনা করে সে যেনো ভালো থাকে, বেঁচে থাকে। যুদ্ধ করে দেশকে মুক্ত করতে পারে। যুদ্ধ চলছে। মুক্তিসেনা ধরা পড়েছে। শুনলে আনার ভাসুর দাঁত বের করে হাসে। বলে-
: যাই দেখে আসি তোমার ভাই ধরা পড়লো কিনা। বেয়াদব ছোড়াটাকে কিছু উত্তম মাধ্যম দিয়ে আসি। আমি এখন শান্তি কমিটির সভাপতি। ছোড়া কোনো সাহায্য চাইলে করতে পারি। তোমার খবরটাও জানিয়ে আসবো, তুমি যে এখন আমার পিঞ্জিরার পাখি।
আনার কোনো ভাবান্তর হয় না। ভেতরটা ছ্যাত করে উঠে। শুধু তার ভাই নয়। সকল মুক্তিযোদ্ধার জন্য দোয়া করে সে। জমির মিয়া একদিন নতুন শাড়ি কিনে আনে আনার জন্য। তাকে ডেকে বলে-
: এভাবে আর তোমাকে দেখতে পারছি না। চল নিকাটা সেরে নেই।
আনা চুপসে যায়।
: আমি আপনাকে বড় ভাই জানি। আমি আপনার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী।
: হুঁ ! জানতে, আমিও জানতাম। কিন্তু এখন আর জানার কাজ নাই। তুমি আমার ময়না পাখি। তোমাকে খাঁচায় নিয়ে নাচাবো, খুদ কুড়ে খাওয়াবো।
আনা কেঁদে ফেলেÑ
: আমি বিধবা। আমাকে পাপিষ্ঠা করবেন না। আমার স্বামীর স্মৃতিটুকু নিয়ে বাঁচতে দেন। আমার মেয়েদেরকে বুকে নিয়ে বাঁচতে দেন।
আনার ভাসুর জমির মিয়া পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসে। শয়তান কখনো ভালো কথায় বশ হয় না। আনা মনে মনে বলে-
: মালিক তুমি কাফেরকে এতো শক্তি দিয়েছো।
মাঝরাতে আনার ঘরের দরজায় নাড়া দেয় তার ভাসুর। আনা ভয়ে গুটিয়ে থাকে। দরজা খোলে না। পরদিন সকালে আনাকে শাসিয়ে বলে-
: চার মেয়ে সহ তোমাকে মিলিটারির হাতে তুলে দিবো। তোমার ঐ ফুলের শরীর ছিঁড়েকুড়ে শেষ করবে একপাল শকুন। সাথে সাথে ঐ বাচ্চা মেয়েদেরকেও। ভালোয় ভালোয় যদি রাজি না হও ...
আনার সামনে বাঁচার কোনো পথই খোলা নেই। বড় বোনেরও একটা খোঁজ পায় না সে। কোথায় কোথায় যে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তারা। কতদিনে যে যুদ্ধ শেষ হবে। দেশ স্বাধীন হবে তো! আনার ভাই আসবে তো তাকে বাঁচাতে। আরো শত শত মুক্তিযোদ্ধা আসবে। ঐ শয়তানটার দাঁত ভাঙ্গবে। আনা অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু জমির মিয়া আর অপেক্ষা করতে পারে না। সে দিনদুপুরে আনার শ্লীলতাহানি ঘটায়। আনা বাধা দেয়ার নিষ্ফল চেষ্টা করে। বিধবার শ্লীলতাহানি। খোদার আরশ কি কেঁপে উঠেনি। লজ্জায় ঘৃণায় আনার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। তার সামনে একটাই রাস্তা খোলা আছে। এই অপমানের গ্লানি থেকে সে মুক্তি পেতে পারে আত্মহত্যা করে। কিন্তু তার সন্তানেরা ! তাদের কী হবে ! তারা কী নিয়ে বাঁচবে? কোন পরিচয়ে, আত্মঘাতি মা’র পরিচয়ে !
আনা মরতে পারে না তার নিষ্পাপ শিশুদের কথা ভেবে। বারে বারে গোসল করে সে। তার শরীর যেনো তাতেও পাপমুক্ত হয় না। এর মাঝে নয় মাসের যুদ্ধও শেষ হয়ে আসে। গাঁয়ে মুক্তি ঢুকেছে। জয়বাংলা বলে দলে দলে ঢুকছে তারা। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। দৌড়ে পালাতে চাচ্ছে শান্তি কমিটির লোকজন। রাজাকার আলবদরেরা। পালাচ্ছিলো জমির মিয়া। গাঁয়ের লোকজন তাকে পিছু ধাওয়া করে ধরে ফেলে আর পিটিয়ে মারে। সে খবর শুনে আনার বুকের উপর থেকে জগদ্দল পাথর নেমে যায়। কিন্তু আনা তার শরীরকে আর পাপমুক্ত ভাবতে পারে না। আনার ছোট ভাই এসেছে। বড় বোন ফিরেছেন। ছোট ভাই বারেবারে জানতে চেয়েছে-
: ঐ শয়তান তোর কোনো অমর্যাদা করেছিলো।
আনা শুধু চোখের জলে ভেসেছে। ছোট ভাই কী বুঝেছে কে জানে।
বলেছে-
: তোর কিছু হয়নি। তুই ঠিক আছিস। এই স্বাধীনতার জন্য শত শত মা-বোনের ইজ্জত গেছে। তাই বলে তারা অপবিত্র হয়ে গেছে? তোর চোখে আর জল দেখতে চাই না আমি। আনা তবুও বারে বারে গোসল করে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে সময়ে অসময়ে গোসল করে আনা। এটা তার রোগ হয়ে গেছে। ছোট ভাই বলে-
: চল তোকে ডাক্তার দেখাই। তুমি মানসিক রোগী হয়ে গেছিস।
আনা বলে-
: না, আমি ভালো আছি। একটা সাপ আমাকে কামড় দিয়েছিলো। ঐ বিষটা কোনোদিন সারবে না। অষুধ পত্রে কাজ হয় না এ বিষের।
ছোট ভাই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হয় বড় মূল্যবান একটা কিছু হারিয়ে ফেলেছে তার বোন। আর বুঝি এটা ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।
আনার মেয়েরা বড় হয়েছে মামার আদর ভালোবাসা পেয়ে। বিয়ে হয়েছে। সংসার করছে। ভালো আছে তারা সবাই। আনার এখন অনেক বয়েস। চলে যাওয়ার সময়। ভাই বোন দু’জনই চলে গেছে। নাতি পুতির মাঝে আনার সময় কেটে যায়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের কথা সে কখনো বিস্মৃত হতে পারে না। যখনই বেশি করে মনে পড়ে সেই বিদগ্ধ স্মৃতির কথা সে গোসল করে আসে। ঐ অপরিচ্ছন্ন লোকটার ময়লা যেনো তার শরীরে লেগেই আছে। কিছুতেই যেতে চায় না। ও যে রাজাকার। ওর মতো ঘৃণিত স্বাধীন বাংলাদেশে আর কেই হতে পারে না।
0 comments:
Post a Comment