বুলি তোমাকে লিখছি
সুব্রত বড়ুয়া
আমি কখনো সমুদ্রে যাইনি। সমুদ্রের সেই উত্তাল তরঙ্গের বিপুল করতালির ওপর ভাসতে ভাসতে কখনো সীমাহীন নীল দেখতে দেখতে নিজেকে বিস্মৃত হইনি। কখনো কখনো সাগরের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতে ভালো লাগত। হু-হু শব্দে ভেসে আসা বাতাসের বুকের গভীরে দাঁড়িয়ে এক-একসময় বিহ্বল হতাম বটে কিন্তু সমুদ্রে নামতে আমার ভীষণ ভয়। আমি মাটির পৃথিবীর মানুষ, মাটির ওপর যতক্ষণ থাকি ততক্ষণ ভরসা থাকে। তুমি তো জানতে বুলি, আমি খুব বেশি কিছু চাইনি। চক মিলানো বাড়ি, চমৎকার গাড়ি, চকচকে মেয়েমানুষ, কোনো কিছুই ব্যাকুল হয়ে কামনা করিনি।
কিন্তু মানুষের চাওয়া-পাওয়ার মাঝখানে কি কোনো নির্দয় সীমারেখা জোর করে টেনে দেওয়া চলে? নাকি অঙ্কের নির্ভুল হিসাবে জীবনের ছক-কাটা ঘরে সবকিছু একাকার করতে পারা যায়? হয়তো যায়, হয়তো বা যায় না। সে আমি কোনোদিন খুব বেশি করে ভেবে দেখিনি। কিংবা বলা যায়, ওই ভেবে দেখায় আমি কোনো ফল দেখতে পাইনি। অথবা দেখতে পেলেও কী! আমি একজন সাধারণ মানুষ। অসাধারণ হবার চেষ্টা যে কখনো ছিল না, এ কথা ঠিক নির্দ্বিধায় বুকে হাত দিয়ে বলতে পারছি না। প্রথম দিকে যখন ঠিক জীবনকে বুঝতে পারিনি, তখন আকাশকুসুম অনেক কিছুই তো ভেবেছি। ওই দেখো, কথাটা এমনভাবে বলছি যেন জীবনকে আমি কত চিনে ফেলেছি! তুমি হলে বলতে, আহা, কত যেন ন্যাকা! ন্যাকা! ন্যাকা কথটা তুমি খুব ব্যবহার করতে। আর বলবার সময় বাচ্চা মেয়ের মতো মাথা দুলিয়ে এমনভাবে তাকাতে যেন সাংঘাতিক একটা কিচু বুঝে ফেলেছ তুমি। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে তোমার মুখটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। কখনো নাক, কখনো চোখ, কখনো চিবুকের নিচে সাদা কণ্ঠা, কখনো বা এক টুকরো হাসি। অথচ সব মিলিয়ে পুরো তোমাকে একসাথে স্মরণ করতে পারছি না। এই মনে করতে না পারায় আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, মুঠোর মধ্য থেকে বিন্দু বিন্দু জল চুইয়ে পড়ার কষ্ট।
আজ এ মুহূর্তে পেছনে ফেলে আসা পুরো জীবনটাকে আমার কাছে স্বপ্ন বলে মনে হয়। কোনো পরম পুরুষের কাছ থেকে জেনে নিতে ইচ্ছে করে জীবনে যা ঘটে তার সবই কি সত্যি! নাকি কোনো স্বপ্নের মধ্যে আমরা জেগে ছিলাম, আবৃত কুয়াশার অন্ধকারে পরস্পর পরস্পরকে জেনেছিলাম।
এখানে এই সাড়ে এগারোটার দুপুর ছুঁই-ছুঁই রোদ্দুর এখন বাড়ির বাইরে এক চিলতে উঠানে গা বিছিয়ে তেজ নিচ্ছে। ঘরের ভেতর দোতলার একটা ঘরে আমি মেঝেয় শুয়ে লিখছি। কাকে? তোমাকে?
বুলি, আমার এ লেখা যদি তোমার হাতে পড়ে তাহলে তুমি কী ভাববে জানি না। অথবা তুমি কিছু ভাবলে আমার কী! কারও ভাবনার মধ্যে অন্তর্গত হয়ে বেঁচে থাকায় কী সুখ! সুখ কি শুধু বোধের মধ্যে, চৈতন্যের মধ্যে চোখ বুজে শুয়ে থাকা অ্যাকুইরিয়ামের সোনালি মাছ?
এখানে দুপুর গড়িয়ে যায়, বিকেল নামে তন্ময়। কাছের রাস্তায় গাড়ির শব্দ। সিঁড়ির পাশের ঘরে থাকি বলেই সারাক্ষণ ওঠা-নামার উড়ন্ত শব্দ ঝুলতে থাকে মগজের মধ্যে। ঘর বলতে বুঝি নিরাপদ আশ্রয়, নির্বিঘ্ন শান্তি।
তোমার ঠিক মনে আছে কি না জানি নে, তুমি একদিন হাসতে হাসতে (মজা করে?) ঘর বাঁধার কথা বলেছিলে।
ঘর! দুপুরে কলেজের ক্লাস পালিয়ে তোমার সেই বান্ধবীর বাসায় এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছিলে, জানেন, আপনার জন্য ইংরেজির ক্লাস না করেই চলে এলাম।
ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার ইংরেজির ক্লাস বিসর্জনের মতো চরম আত্মত্যাগের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়া আমার উচিত ছিল কিংবা একটি দুরন্ত চুম্বন। অথচ আমি কী বোকা! বলেছিলাম, ‘না এলেই পারতে।’
ততক্ষণে আমার হাতে বেশ জোরেশোরে একটা চিমটি কেটে বলেছিলে, ‘আহা।’
তোমার কথা বলার ঢংটা আমার ভালো লাগেনি। নিজেকে ভীষণ রকম ক্ষুদ্র আর অসহায় মনে হচ্ছিল। কেবলই জানতে ইচ্ছে করছিল, কী এমন লাভ ওই লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখা এবং অর্থহীন শব্দ ছুড়ে।
তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলেছিলাম, ‘আচ্ছা বুলি, বলতে পারো, এমনি ভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ?’
আমার কথা শুনে তুমি অবাক হবার ভান করেছিল। তোমারÑতুমি এবং তোমার মতো মেয়েরা, এত মধুর সব ভান করতে পারো যে, আমরা যেন ওই সব দেখেশুনে নিয়মের ঘোড়ারমতো বর্তে যাই।
অতঃপর মৃদু হেসে বলেছিলে, ‘না মশাই, ঘর বাঁধার জন্যই এত সব! আমরা ঘর বাঁধব, বাঁচব...তারপর একদিন মরে যাব। তখন থাকবে আমাদের ছেলে-মেয়েরা।’
আমাদের ছেলে-মেয়েরা, এ কথা শুনতেই আমি চমকে তোমার দিকে চেয়েছিলাম। তুমি, চোখে চোখ পড়তেই, ঈষৎ হেসে মুখটা নিচু করেছিলে। আমি নিজের মনে হেসেছিলাম। কেন? টিক মনে করতে পারছি না। আচ্ছা, আমাদের ছেলে-মেয়েরা কথাটা বলে তুমি সেদিন কী বোঝাতে চেয়েছিলে? কিংবা আদৌ কিছু একটা কি বোঝাতে চেয়েছিলে তুমি?
আমি কি ভেবে হেসেছিলাম? এখন আর আমার কোনো কিছুই মনে পড়ছে না। আদতে সে মুহূর্তে কিছু একটা কি ভেবেছিলাম? নিজের ভাবনাগুলোকে যদি সেলুলয়েডের ফিতের মতো কিছু একটাতে বেঁধে রাখতে পারতাম! তাহলে হয়তো একদিন ফের দেখতে গিয়ে অবাক হতাম। কত অসম্ভব অবাস্তব সব ভাবনা! মনের মধ্যে নিজের একটি ভুবন তেরি করেছিলাম, সে আমার একান্ত নিজস্ব। দোতলার ঘরে হাওয়া দিচ্ছে। কোন্ দিকের হাওয়া বুঝতে পারছি না। এখানে দিক নেই, আমি চিনি না! রাস্তায় নেমে মানুষ দেখলে ভয় পাই, গাড়ি দেখলে চমকে উঠি। ভয় আমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রবারের পুতুল। চলতে ফিরতে শব্দ করে, হাওয়ায় মন রাখলে যেন কান্নার শব্দ শুনি।
জীবনটা সত্যিই আশ্চর্য! বুলি, শব্দের পর শব্দি সাজিয়ে তোমাকে আমি ঠিক বোঝাতে পারব না, কী আমি ভাবছি! কী ভাবছি সেটা কি নিজের কাছেও খুব বেশি স্পষ্ট? সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর পারে জনাকীর্ণ লন্ডন শহরে বসে তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না কি ভীষণ ভয়ংকর সময়ের মধ্য দিয়ে এগাচ্ছি আমরা। সবকিছু কেমন উল্টে গিয়ে চেনা-ভুবনের সাজানো ছবিটা হারিয়ে গেল কোথায়! কোথায়?
সাজানো বাগান হয়ে গেল এলোমেলো!
এলোমেলো! কত লক্ষ লোকের জীবন হারিয়ে গেল!
বুলি, তোমার ওই সাজানো ঘরে বসে এখন তুমি কী ভাবছ জানি না। তোমার ভাবনায় অবশ্য আমাদের কিছুই আসে যায় না। অথচ তবু ঠিক লিখতে বসে তোমার কথাই মনে পড়ল। কেন? নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করছি। কিন্তু জবাব দেবে কে!
আমাদের সেই স্বপ্নের শহরটার কথা তোমার এখনো মনে আছে কি না জানি না। আশৈশব সেই স্মৃতির শহরকে আমি কখনো ভুলতে পারি না।
আমি তো ভুলওেত চাই না!
পঁচিশে মার্চ সন্ধেয় নিজেকে ভীষণ একা লাগছিল। সারা দুপুর ঘুমোবার নাম করে বিছানায় শুয়ে বই নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। ঋৎধহু কধভশধ¬-র উধরৎু। ঠিক ডায়েরি বলতে যা বোঝায় এটা তা নয়। দিনলিপির নির্ভেজাল সংবাদ পরিবেশন নয়। তার চেয়েও বেশি। একজন অন্বিষ্ট স্রষ্টার আন্তরিক প্রতিবেদন।
পড়তে পড়তে নিজের দিকে বারবার ফিরে চাইতে ইচ্ছে করে। রেডিওটা খারাপ হয়ে ছিল। টিউনিংয়ের কাঁটা কেবল এক জায়গায় অনড় অচল। চালিয়ে দিলে ঢাকা বেতারের অসহ্য কমার্শিয়াল সার্ভিস।
[এই মুহূর্তে আমার পাশে বন্ধুরা আড্ডা মারছে। সারা দিনের কাজের ফাঁকে সামান্য অবসর। বিবিধ ভারতীয় অনুষ্ঠানে মহম্মদ রফি গাইছেনÑমুঝে তুম ইয়াদ আইয়ে।]
ভালো কথা! ইয়াদ আইয়ে। ইয়াদ মানে স্মরণ। স্মরণে কতজনকেই তো মনে পড়ে। কিন্তু একজনের কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। কে সে?
সেদিন দুপুরে কার কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়েছিল, আজ আর তা মনে নেই। মনে নেই। মাঝেমধ্যে ক্যাপস্টানের প্যাকেট থেকে একটা করে সিগারেট তুলে নিয়ে দেশলাইয়ের গায়ে কাঠি ঘষি। সিগারেটের ধূসর ধোঁয়া কেমন স্বপ্নের মতো শূন্য মিলিয়ে যায়। শূন্যে মিলিয়ে যায়। শূন্যে মিলিয়ে যায় আর আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। আমাদের সাধের স্বপ্নেরা এমনি করে শূন্যে শেষ হয়ে যায়।
বুলি, না, আমি অনুশোচনা করছি না। যা পাবার কথা ছিল, তা পাইনি বলে কপালে করাঘাত করে, দুঃখ করে লাভ কী!
সারা দুপুর এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়ে দিয়ে বিকেলে উৎকর্ণ হয়েছিলাম আইনুলের টেলিফোনের জন্যে। প্রতিদিনি বিকেলে আইনুল আসত। আসার আগে টেলিফোন। আমি কাপড় পরে তৈরি থাকতাম। দরজার পর বন্ধ গেটের বাইরে গাড়ির হর্ণ শুনলেই বুঝতাম, আইনুল এসে গেছে। তারপর সেই চেনা গাড়ি, চেনা রাস্তা, চেনা দোকান এবং চেনা জায়গায় বসে চা খাওয়া। চা খেতে খেতে গল্প। অথবা গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো।
বুলি, তোমার মনে পড়ে কি না জানি না। মাঝে মধ্যে দুপুরে একটা চীনা গল্প করা চলত। কাউন্টারে বসত যে ছেলেটা, আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসত। কেন? ও কি বুঝতে পেরেছিল আমরা খেতে নয়, বরং গল্প করতেই আসি!
বসে বসে কথা বলতাম। কী কথা? হাজার রকমের কথা। আজ এই মুহূর্তে সে-সব কথার কোনো অর্থ আমি খুঁজি পাই না।
তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানি না। আমি কিন্তু তোমার যাবার পর কখনো কোনোদিন আর ওই হোটেলে খেতে যাইনি। কখনো পাশ দিয়ে যেতে হলে ভীষণ ভয় পেতাম। নিজের সবকিছু হারিয়ে যাবার ভয়।
পঁচিশে মার্চ সন্ধেয় আইনুল আসেনি। টেলিফোনও করেনি। সন্ধে হতেই আমি একা বেরিয়েছিলাম। সারা শহর কেমন এক চাপা উত্তেজনায় থমথম করছে। লোকগুলোর চোখেমুখে তীব্র আশঙ্কার ছাপ। রাস্তায় নামতেই খোলা বাতাস গায়ে হাওয়া লাগিয়ে গেল।
মোড়ের দোকানটা থেকে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে দাঁড়ালাম। দোকানি সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে খুচরো পয়সা গুনতে গুনতে বলল, ‘শেখ সাহেবের সাথে মিটমাট হবে নাকি, সাব?’ দেশলাইয়ের কাঠি ঠুকতে গিয়ে আমি থমকে পড়েছিলাম। কী উত্তর দেব আমি! আমার নিজের তো কিছুই জানা নেই।
বললাম, দেখা যাক কী হয়।
কথাটা যেন নিজেকেই বলেছিলাম। দেখা যাক কী হয়। নেহাত ভবিষ্যতের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনে। ভাবছিলাম, কোথায় যাব।
আমার আজন্ম স্মৃতির শহরটাকে ঠিক যেন চিনতে পারছিলাম না। রাস্তা ফাঁকা। কমিশনারস হিলটাকে বাঁয়ে রেখে ফুটপাত দিয়ে এগোচ্ছিলাম। ডাস্টবিনের ময়লা উপচে পড়ছে একপাশে। পেচ্ছাবের গন্ধ। এক জায়গায় পানি জমে আছে। সাবধানে হাঁটছি। ডান হাতের আঙুলে সিগারেট পুড়ছে। রাস্তার অপর পাশ দিয়ে একদগল মেয়ে কথা বলতে বলতে আমাকে পেছনে রেখে বিপরীতে চলে গেল। ওদের মতো অনেককেই প্রতিদিন বিকেলে হাঁটতে দেখি। জামাতখানা থেকে বেরিয়ে ওরা চলে যায়। আবার প্রতিদিন বিকেলে আসে। আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে, ওই উঁচু দেয়ালটার অন্তর্গত কী এমন আছে, যেখানে ওরা প্রতিদিন আসে।
বুলি, আমার বন্ধুরা বলে, ছুড়িগুলো দেখতে খাসা মাইরি! ওই দেখো কথাটা এমনভাবে বললাম যেন এতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ-অনাগ্রহ নেই। না, তোমার কাছে সাধু সাজবার এতটুকু সদিচ্ছা আমার থাকার কথা নয়। আমি শুদু একটি কথাই বলতে পারি, আমিও তো একজন মানুষ।
রাস্তাটার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। এখানটায় মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারি। আর কাউকে পটাতে পারলেই সামনে ঘিঞ্জি নোংরা ছোট রেস্তোরাঁটায় বসে চা খাই।
আজ কেউ নেই। ফাঁকা জায়গাটা খাঁ খাঁ করছে।
ঠিক এখানটায় এসে আর একজনের কথা মনে পড়ছে। ওকে তুমি চেনো বুলি। ভীষণভাবে চেনো। নাম শুনলে হয়তো চমকে উঠবে। চমকে উঠে স্থির নিষ্পম্প দৃষ্টিতে বলবে, এ আমি জানতাম।
কিন্তু আমি জানতাম না। অথচ ঠিক আমিই শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে গেলাম ওর সাথে।
যুঁই সবই জানত। সব জেনেও সামনে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘আমার যে আর অন্য কোনো উপায় নেই। আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। নিজেকে ফাঁকি দেবার সাধ্য আমার নেই।
বুলি, আমি ওকে ফেরাতে পারিনি।
মোড়ের খালি জায়গাটায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটটা শেষ করলাম। বেশ হাওয়া দিচ্ছিল। ভাবছিলাম যুঁইদের বাসায় যাব কি না! তোমার বান্ধবী যুঁই। যুঁই আমাদের সবকিছুই জানে, বুরি, সবকিছুই জানত। আর কখনো তোমাকে নিয়ে কথা উঠলে হঠাৎ করে কেঁদে ফেলত।
সেদিন যুঁইদের বাসায় যাইনি। বাঁ দিকের পথটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে টেলিগ্রাফ অফিসের সামনে। রেস্তোরাঁটায় ঢুকতেই দেখা পেলাম সবার। সব মক্কেলই আছে, তুমুল কথা চলছে। একদিকে বসে পড়লাম। মনে পড়ল, আমার এক কাপ চা খাওয়া দরকার। বিকেলে চা না খেলে এমন মাথা ধরে।
চায়ের অর্ডার দিয়ে কথার মধ্যে ডুবে গেলাম। সবাই কেমন উত্তেজিত। কিছু একটা ঘটছে। কিন্তু কী! এমন কেউ কি নেই যে বলে দিতে পারে কী এমন ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন এগিয়ে আসছে নির্ধারিত ট্রেনের মতো, অজগরের মতো!
নিরঞ্জন পান চিবোচ্ছিল আর কেবলই বাইরে গিয়ে কী যেন দেখছিল। সামনে ওয়াসার কাজ হবে বলে রাস্তাটা খোঁড়া। জলের পাইপ লাইন বসাবার জন্য বিরাট সব লম্বা গর্ত। অসাবধানে পেরোতে গেলেই গলা পর্যন্ত ডুবে যাবে।
কোনার দিকে এক টেবিলে বসে শাহেদ, লতিফ আর হাবিব কী যেন বলছে। কী!
আগের দিন বিকেল থেকেই সারা শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। রোববার সকালে গিয়ে আমি জাহাজটা দেখেছিলাম। আইনুল সকালে এসে বলেছিল, ‘চল, পোর্টে যাবি।’
আমি ওর সাথে বেরিয়েছিলাম। তারপর সেই জাহাজটা, কী যেন নাম, সোয়াত না কী দেখেছিলাম। পঁচিশ গজ দূর থেকেই গাড়ি ঘুরিয়ে নেবার সবয় আইনুল বলেছিল, ঐ যে দাঁড়িয়ে, ওটিই অস্ত্রবাহী জাহাজ।
আমি ভয় পেয়েছিলাম ওর কথায়। জনা আষ্টেক সৈন্য রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে সামনে। ওরা আমাদের দেখছিল। চোখের দৃষ্টিটা যেন রক্তখেকো বাঘের মতো।
গিয়ারটা বদলাতে বদলাতে আইনুল বলেছিল, ‘লেবাররা সাফ জবাব দিয়েছে, কেউ মাল নামাবে না, নামাতেও দেবে না।’
কী যেন একটা ভাবছিলাম আমি আইনুলের কথার উত্তরে, শুধু বলেছিলাম, ‘ও।’
আইনুল আর কথা বলেনি। স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছিল। পোর্টে আইনুলের কাজ শেষ। এবার গিয়ে বসব আমরা অথবা কোনো স্পেশাল শোর টিকিট।
২৪-এ মার্চ বিকেল তিনটে থেকেই শুরু হলো গণ্ডগোল। সৈন্যরা জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে গিয়েছিল। শ্রমিক-জনতা বাধা দিল। না, অস্ত্র নামানো চলবে না। শেখ সাহেবের সাথে আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অস্ত্র আমরা নামাতে দেব না।
তারপর। তারপর শুরু হলো গুলি। অনেক লোক মরল। ততক্ষণে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড, গাড়ি চলাচল বন্ধ। সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল একটা তীব্র বিস্ফোরণ।
তারপর কেমন করে যেন মিটমাট হলো। কিন্তু ব্যারিকেড সরল না। সারা রাত অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে রইল মানুষ। জেগে রইল গুঞ্জরন, শব্দ, সন্দেহ, উত্তেজনা আর চাপা বিক্ষোভ।
এই এক দিনে সবকিছু কেমন যেন বদলে গেছে। আমি চা শেষ করলাম, সিগারেট ধরালাম। সবকিছু কেমন যেন বিস্বাদ লাগছিল। থমথমে পরিবেশ। বন্ধুরা সবাই যেন ভয়ংকর একটা কিছু আশা করছে। ভীষণ ভয়ংকর তীব্র, অচিন্তনীয়।
হঠাৎ মনে পড়েছিল, যুঁইদের বাসায় গিয়ে একবার ঘুরে আসলে ভালো হতো। ওরা নিশ্চয়ই এই নিয়ে ভাবছে।
কয়েকদিন আগে যুঁইকে যখন বলেছিলাম, ‘দু-একদিনের মধ্যেই ঢাকায় ফিরছি’, ও প্রায় আঁতকে উঠেছিল।
ভীষণ কাছে এসে বলেছিল, ‘না লক্ষ্মীটি, না। পঁচিশ তারিখের আগে তুমি কিছতেই যেতে পারবে না।’
যুঁই। বুলি, যুঁইয়ের নাম করলেই তুমি রেগে যেতে। তুমি ওকে একেবারে সহ্য করতে পারতে না। কেন? হয়তো তোমার ওই রাগের পেছনে একটা যুক্তি ছিল। তুমি কি ভেবেছিলে, আমি তোমাকে নিয়ে খেলছিলাম?
এই মুহূর্তে এর বিপরীত কথাটাই আমি ভাবতে পারি। আমার জায়গায় তুমি আর তোমার জায়গায় আমি। মানুষ কী ভীষণভাবে বদলে যায়।!
বুলি, তোমার বিয়েল দিন সানাই বেজেছিল কি না জানি না। সানাই শুনলে আমার কান্না আসে। মনে হয়, আমি যেন ডুবে যাচ্ছি। আমার চারদিকের মানুষ, উজ্জ্বল আলো, শব্দ-ছন্দ-গান সবকিছু পেরিয়ে আমি যেন বিশ হাজার লগি অতলে তলিয়ে যাচ্ছি!
সেই সন্ধেয় যুঁইদের বাসায় আর যাওয়া হয়নি। কখন আটটা বেজে গেল। পোকার মতো মানুষেরা রেডিও ঘিরে খবর শুনছে।
খবর! শব্দ! শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে একটা দাঁড় করানো চলে। আমরা পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে খবর শুনছিলাম। ইয়াহিয়ার নাম বলতেই কে একজন ভিড়ের মধ্যে চিৎকার করে বলল, শুয়োরের বাচ্চা।
তুমিও নিশ্চয়ই এত দিনে অনেক খবর শুনেছ। সংবাদপত্রে বোল্ড টাইপে বাংলাদেশের খবর অনেকবার নিশ্চয়ই ছাপা হয়েছে। এই চার মাসে রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্রে এই সব দেশতে দেখতে, শুনতে শুনতে তোমার অজানা আর কিছুই নেই। তবু আর একবার বলি, আশি লক্ষ লোক দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তানি জল্লাদদের হাতে মরেছে দশ লক্ষ, হাজার হাজার মেয়ের সর্বনাশ হয়েছে, শিকার হয়েছে নরপশুদের কমোল্লাসের।
জানি, এসব তোমরও জানা। তোমার লন্ডনের ঘরে ফায়ারপ্লেসের বসে তুমিও নিশ্চয়ই আতঙ্কে ভয়ে শিউরে উঠেছ। ভেভেছ, এ-ও কি সম্ভব!
হ্যাঁ, সম্ভব।
আমি এখন সংবাদ পরিক্রমায় আবার নতুন করে তাই সব শুনলাম। শুনতে শুনতে আজকাল আর ভয় পাই না। তেমন কোনো চিন্তাও আসে না। শুধু জানি, আমরা লড়েছি।
তুমি রেগে যেয়ো না, বুলি। আর একবার যুঁইয়ের কথা বলছি। সেদিন সন্ধেয় ওদের বাসায় আমি যাইনি। যেতে পারি নি। না, তার পরদিনও না। তারপর আর কখনো যাইন। যাবার দরকার হয়নি।
শুধু খবর পেয়েছি, ওর সেই দুর্দান্ত ছোট ভাইটি নরপশুদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করেছে। আমি ওর কোনো খবর জানি না। জানি না বেঁচে আছি কি না! কিংবা বেঁচে থাকলেও এই মুহূর্তে আমি কিছুই করতে পারি না।
বুলি, এসব জেনে তোমার আনন্দ হবে এমন আশা আমি করি না। কিংবা না জানলেও কী এমন ক্ষতি তোমার!
আমি নিয়তির সামনে দাঁড়িয়ে জীবনকে গ্রহণ করেছি। আমরা সবাই জীবনের কাছে শপথ নিয়েছি, আমাদের ছেলে-মেয়েরা বেঁচে থাকবে। না, তোমার আমার ছেলে-মেয়েরা নয়। সে কথার কোনো প্রশ্নই আজ আর ওঠে না। তা ছাড়া, এত দিন পর কথাটা তোমার মনে না থাকার-ই কথা।
আমি বলছি, আমাদের ছেলে-মেয়েরা। স্বাধীন বাংলাদেশের আগামী দিনের মানুষেরা। ওরা সুন্দরবাবে বাঁচবে বলেই আমরা মরছি!!
0 comments:
Post a Comment