এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
সরদার ফজলুল করিম
ক্যাসেটের বাজারে ৭ মার্চের সেই ক্যাসেটটি কিনতে পাওয়া যায়, আমি একিট কিনেছি। ‘৭১ –এর ৭ মার্চ দুপুর গড়িয়ে বিকেলে সেরকোর্সের ময়দানে শেখ মুজিব যে ভাষণ দিয়েছিলেন, ক্যাসেটটিতে সেই ভাষণের, মনে হয় পুরোটাই আছে। ছোট-বড় যে কোনো ক্যাসেট বাজানোর যন্ত্রে দিলেই সেই কণ্ঠ শোনা যায়। সেই কণ্ঠ তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে বলতে বলতে শেষে বলে ওঠে : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
বৈজ্ঞানিকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় একদিন তৈরি হলো গ্রামোফোন নামক একটি যন্ত্র, শক্ত রেকর্ডে শব্দকে আটকে রাখার কায়দা। সেই শক্ত রেকর্ডের গায়ে কাঁটা বসিয়ে ঘুরিয়ে দিলেই যে শব্দ একদিন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতো, সেই শব্দ হুবহু বেজে ওঠে: কণ্ঠের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ওঠা পড়া। কোনোটিই আর নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপায় নেই। অন্তত বেশ কিছুকাল, বছর থেকে বছর, যুগ থেকে যুগ।
সেই কৌশল আজ আরো কতদূর এগিয়েছে। এখন শব্দের ফিতা তৈরি হয়েছে। সেই ফিতাও ঘোরাতে থাকলে শব্দ ঠিক বেজে ওঠে। কেবল যে বেজে ওঠে তাই নয়। শব্দের উপরে নতুন শব্দ আজ চালাক মূর্খ যে কেউ ইচ্ছামতো তুলে রাখতে পারে। আমি নিজে বৈজ্ঞানিক নই। মুর্খ মানুষ। ফিতা খুলেও আমি দেখেছি। ওতে ছাই, কিচ্ছু দেখা যায় না। তবু মেশিনে দিলেই আবার বেজে ওঠে। আমি আগে ভূত বিশ্বাস করতাম না। এখন করি। এ একেবারে ভূতুড়ে কারবার। আমার কাছে অপার রহস্যের ব্যাপার। একেবারে অলৌকিক। কিন্তু আমি কৃতজ্ঞ এই ক্যাসেট-ভূতের কাছে। এই ক্যাসেট এসেছে বলেই না ৭ মার্চের সেই লাখো লোকের মাঝে দাঁড়িয়ে একটি রূপান্তরিত মানুষের তাঁর নিজেও অজানিত তাৎপর্যে উচ্চারিত স্বপ্ন, কামনা আজও আমার কানে সাক্ষাৎভাবে বেজে ওঠে।
ক্যাসেটটি ছাড়লেই আমি যে কেবল তুলনাহীন সেই দরাজ কণ্ঠের আওয়াজ শুনি : ‘ভাই এরা আমার মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, তাই নয় । আমার চোখের সামনে সমগ্র দৃশ্যপটটি ভেসে ওঠে। রেসকোর্সের বিরাট মাঠ। লোক আসতে শুরু করেছে দশটা না বাজতে। শেখ সাহেব বত্তৃতা দিবেন বোধ হয় আড়াইটায়। আমি থাকি তখন মতিঝিল কলোনিতে। চাকরি করি বাংলা একাডেমিততে। সেদিন কি আমার অফিস খোলা ছিল? এ প্রশ্ন অবান্তর। একুশে ফেব্রুয়ারী আর পহেলা মার্চের পর থেকেই বাংলাদেশের মানুষের কোনটা কাজএবং কোনটা কাজ নয়, কোনদিন আমাদের সকলেরই অফিস ছিল, করণীয় ছিল। করণীয় ছিল রেসকোর্সের ময়দানে হাজির হওয়া, করণীয় ছিল শেখ মুজিবের ভাষণ শোনা। আমার আগ্রহ ছিল কেবল ভাসণ শোনা নয়, জনতাকে দেখা। শেখ মুজিবকে সেই সুউচ্চ মঞ্চ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে দেখা যাবে না, সে আমি জানতাম। শেখ মুজিব আমার খুব যে অপরিচিত ছিলেন, এমনও নয়। একটি বাঙালি মধ্যবিত্তের মধ্যবয়সী মানুষ। আমার প্রায় সমবয়সী। একেবারে সময়বসী যে, তা নয়। আমার জ্যেষ্ঠ, কিন্তু সাংঘাতিকভাবে নয়। মাত্র নয়-ছয়ের ব্যবধান হয়তো। কিন্তু সে পুরুষ দীর্ঘ ছিলেন আমার চাইতে অনেক। মানুষের শরীরের সঙ্গে মানুষের মনের নিশ্চযই একটা যোগাযোগ আছে। দীর্ঘ পুরুষের মনে হয়তো সাহস বেশি হয়, ক্ষুদ্র পুরুষেদের চাইতে, আমার মতো ক্ষুদ্র পুরুষদের চাইতে তো বটেই। আর এই এক দুর্ভাগ্য যে, বাঙালিদের বেশির ভাগই আমার মতো ক্ষুদ্র। আবার দীর্ঘদেহী যে একেবারে নেই, তাও নয়। কিন্তু দীর্ঘদেহ হলেই কি বুকে অধিক সাহস জন্মায়? সাহস প্রতিকূল অবস্থার মুখে, সাহস জেলের নির্জন সেলের মধ্যে, সাহস ফাঁসির মঞ্চের সিঁড়িতে? না, দীর্ঘদেহ হলেই বৃহৎ সাহস তৈরি হয় না।
কিন্তু বাঙালি ক্ষুদ্র হলেও অনেক বাঙালি একত্র হলে, ক্ষুদ্র আর কৃশ আর কাহিল বাঙালি একত্র হলে, তাকে আমার বেশ দীর্ঘদেহী, শক্তিশালী ব্যক্তি বলে বাধ হয়। ‘৫২ সাল আমি দেখিনি। কিন্তু ‘৬৯ সাল থেকে এ রকম মানুষের সাক্ষাৎ এই ঢাকা শহরেই পল্টনের মাঠে, রেসকোর্সের ময়দানে, শহীদ মিনারের নিচে আর রাস্তায় একাধিকবার পেয়েছিলেম। আর দেখছিলাম অপ্রত্যাশিতভাবে এমন দীর্ঘদেহী মানুষের সংখ্যা যেনো দিনকে দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলেছ, আর সকাল, বিকাল, দুপুর প্রত্যেক রোজই যেনো তাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটছে।
আমি জানতাম ৭ মার্চের রেসকোর্সের নানা শঙ্কা-আশঙ্কাকে উপেক্ষা করে যে মানুষটি হাজির হবেন তাঁর দৈর্ঘ্য এবং সাহস অতীতের সকল দীর্ঘদেহীকেই অতিক্রম করে যাবে। এই মানুষটির চেহারা কীরূপ হবে, সেটি জানার আকর্ষণই আমাকে দুপুর থেকে টানছিল। আমি একবার চেষ্টা করেছিলাম সেই মানুষটির কত কাছে যেতে পারি, তা দেখতে। দক্ষিণ মাথা দিযে শুরু করে আমি কেবল এগুচ্ছিলাম উত্তরের দিকে। সেই সুউচ্চ মঞ্চটির দিকে। কিন্তু একে তো ঘন প্রাচীর আমাকে এগুতে দিচ্ছিল না সামনে, তাতে যত সামনে এগুচ্ছিলাম আমি, তত আমার মনে হচ্ছিল যেনো বিরাটদেহী সেই মানুষটিকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। আসলে যাকে তুমি বড় করে দেখতে চাও, সমগ্র করে, তার একেবারে কাছে যেতে নেই। তাহলে ক্রমান্বয়ে তার অঙ্গ-প্রতঙ্গেই তোমার নজরে পড়বে : হয় তার পায়ের পাতা, নয় তার দুটি হাত, কিংবা দুই চোখ কিংবা মুখের হাঁ। যাকে তার হাত, পা, মাথা মিলিয়ে তার যে পূর্ণ অবয়ব, সেটি আমার দৃষ্টিতে আসবে। আমি তাই হতাশ হয়ে খুঁজছিলাম কোনো উচ্চস্থান, কোনো দূরত্ব যেখানে থেকে ৭ মার্চের রেসকোর্সে মন্দিরটির বরাবর হটে আসছিলাম। কখানো আরো হটে এসে আমার নিজের অফিস বাংলা একাডেমির একেবার ছাদে আরোহণ করছিলাম।
এমন চেষ্টাতে সেই মানুষটির যা একটু আভাস আমি পাচ্ছিলাম তাতে আমি নিজের অজান্তেই যেনো রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছিলাম। আমি নিজেকে যত ক্ষুদ্রাবয়ব মনে করি, তেমন আর তখন যথার্থই ছিলাম না। আমার অবয়বকে আমি যথার্থই ছাড়িয়ে যাচ্ছিলাম। দেহ আমার দীর্ঘ হচ্ছিল। শরীরে আমার রোমাঞ্চ জাগছিল। সাহস বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আর তাই পাকিস্তানি জঙ্গি বিমানগুলো আমার মাথার উপর দিয়ে সগর্জনে যখন আসা-যাওয়া করছিল এবং সে বিমান থেকে যে কোনো মুহুর্তে যে মৃত্যুর বাণ আমার বুকে এসে বিঁধতে পারে, সে কথা জেনেও আমার পা একটুও কাঁপছিল না। আমি ছুটে পালাতে চেষ্টা করিনি। এ স্মৃতি এক আশ্চর্য স্মৃতি। এই ক্যাসিটটা ছাড়তেই সেই স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে, আর এখনো আমি রোমাঞ্চিত হয় উঠি।
এই আমার এক দুর্লভ ভাগ্য। আজ থেকে তেরো বছর আগের ভাগ্য। আমার যে ছেলেটির বয়স তখন মাত্র পাঁচ, সে হয়তো আমার হাত ধরে ‘৭১-এর ৭ মার্চের সেই মানুষটির দর্শনে গিয়েছিল। কিন্তু তাকে বোঝার মতো সচেতন মন তখনো তার তৈরি হযনি। আজ তার বয়স হয়তো ১৮। ১৮ বছরের তরুণ। ওরই হাজার সঙ্গীসাথী আজ আবার রাস্তায় বেরুচ্ছে, মিছিল করছে, পুলিশের ট্রাকের নিচে নিষ্পিষ্ট হচ্ছে, গুলির আঘাতে ঢলে পড়ছে। এই তরুণদের মিছিল ও আবার স্মরণ করিয়ে দেয় আমাকে ‘৭১-এর সেই মার্চের দৃশ্যকে, ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানকে।
আশপাশের অনেকে প্রশ্ন তোলেন : কিন্তু সেই তেজ কোথায় আজকের মোর্চার মধ্যে, শক্তির সেই দ্যোতনা কোথায়? প্রশ্নটির সঠিক জবাব আমার জানা নেই। তবে সেই শক্তি তথা বোধের যদি অভাব থেকেই থাকে তবে তার একটি কারণ আমার এই মনে হয়, আমার ১৭ কি ১৮ বছরের ছেলেটির ভাগ্য হয়নি ৭১-এর ৭ মার্চকে সচেতনভাবে প্রত্যক্ষ করার।
কিন্তু ইতিহাসের প্রত্যেক মুহুর্তেকে কি পরবর্তীকালের সন্তানেরা প্রত্যক্ষ করতে পারে? এত্ত এক প্রশ্ন। এখন এই মুহুর্তে যেটা প্রত্যক্ষ, পরমুহুর্তে তা পরোক্ষ, তা অতীত । এ মুহুর্তে যে আওযাজ উচ্চারিত, যে মোর্চা সংগঠিত, পরমুহুর্তে তা বিগত, বিলুপ্ত। বস্তুততজগতের প্রবহমানতার এই এক অমোঘ নিয়াম। আর এই নিয়মকে অতিক্রম করার জন্যই মানুষ তৈরি করতে চেয়েছে নানা কলা- কৌশল, ঘটনাকে,তার আবহকে , তার নায়ক-নায়িকাদের কর্মকান্ডকে ধরে রাখার, চিত্রে, লেখনীর অক্ষরে, শব্দে, বিবরণে, বর্ণনায়। যখন থেকে মানুষ চেষ্টা করেছে এসব কলা-কৌশল তৈরি করার, তখন থেকেই মানুষের ইতিহাস রচিত হয়েছে। তখন থেকে নির্দিষ্ট কালকেই মানুষ বলে ঐতিহাসিক কাল তার পূর্বের কাল প্রাগৈতিহাসিক।
মোটকথা মানুষকে সচেতনভাবে চেষ্টা করতে হয় তার জীবনপ্রবাহের যুগান্ত কারী তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাকে, তার নায়ক-নায়িকাকে,তাদের বাণী আর কর্মকান্ডকে এবং সেই কর্মকান্ডের সঙেগ্ যুক্ত আবহকে নানা কৌশলে ধরে রাখার, পুনরুজ্জীবিত করার, যেনো পরবর্তী যে কোনো কালের মানুষ তার পূর্বকালের ঘটনা, মানুষ ও তাদের ক্রিয়া-কর্মকে প্রত্যক্ষের মতো বোধ করতে পারে। কালণ অতীতের মধ্যে দিয়েই বর্তমানের সৃষ্টি। আর তাই অতীতের তাৎপর্যের বোধ বর্তমানের মধ্যে না থাকলে বর্তমান নিজেকে শেকড়হীন, উদ্দেশ্যহীন যাযাবর ভাবতে বাধ্য।
কিন্তু আধুনিককালের মানুষের কিংবা মানুষের কোনো কোনো অংশের এই কৌশলও লক্ষণীয় যে, সে চেষ্টা করে যেনো মানুষ তার অতীতকে বিস্মৃত হয়। এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই বাংলাদেশের বুকেই বিদ্যামান।
বর্তমানের প্রশাসনপ্রধান, সামরিক-বেসামরিক বাহিনী এবং সরকারি, বেসরকারি সব দল স্বীকার করে যে, ‘৭১ এর স্বাধীনতাযুদ্ধের সফল সমাপ্তিতে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ। এ কথা বাংলাদেশর যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য। এবং সকলেরই প্রতিযোগিতা, এই স্বাধীনতাযুদ্ধে তাঁর অবদানই যে বিরাটা, এ কথা প্রমাণ করতে। এবং এ কথাও স্বীকৃত যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, কোনো একটি দল বা গ্রুপের ছিল না। ৭১ সালের সংগ্রাম যথাযর্থই জাতীয় সংগ্রামের রূপ নিয়েছিল এবং সেই সংগ্রামের অনস্বীকার্য নেতা শেখ মুজিব দলীয় নেতার অধিক হয়ে জাতীয় নেতার চরিত্র ধারণ করেছিলেন। বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার মধ্য পরিমাণ বিত্তের কৃষকের সংসারের একটি তরুণ জন্ম থেকে বা রাতারাতি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হয়নি। ‘৭১ সালে শেখ মুজিব যথার্থই বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন বলেই ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটি তাঁর স্বআরোপিত উপাধি নয়। এ আখ্যা ছিল একটি সংগ্রামী জীবনের পতি দেশবাসীর সস্নেহ উপাধি। আর সে কারণেই বাংলাদেশের জীবনে আজকের দিনের বড় প্রশ্ন, সেই অবিসংবাদী জাতীয় নেতার নাম-নিশানা আজ লোকচক্ষুর অন্তরালে কেনো? সরকারপ্রধান তথা রাষ্ট্রযতেন্ত্রর এত যে স্মরণ প্রচেষ্টা, দিবস পালন, বক্তৃতা ও বিবৃতিদান,তাতে বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমানের যত নেতার নাম উচ্চারিত হোক না কেনো, শেখ মুজিবের নাম অনুচ্চারিত।
আমার ইচ্ছা জাগে, আমার চেলের বয়সী সতের কি আঠার বছরের যারা তরুণ, যারা যুবক তাদর কাছ, ‘৭১-এর ৭ মার্চের এই ভাষণটি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করি, এই ভাষণ মুনে তাদের মনে কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে? কিন্তু আঠার’র সঙ্গে আটান্নর ব্যবধান বিস্তর। তাই আমার নিজের ঘরের ছেলেকেও আমি আমার মনের এই কথাটি জিজ্ঞেসকরতেভয় পাই। আমার ভয়ের এক কারণ, আমার সন্তান হয়তো বলবে, ‘হ্যাঁ’ বক্তৃতাটি শুনে মনে হচ্ছে খুব যোশের কথা তো যে কোনো সময়ে যে কেউ বলতে পারে। কিন্তু সেদিন শেখ মুজিব যা বলেছিলেন, তা তাঁর পক্ষে সেদিনই মাত্র বলা সম্ভব ছিল, আর সে ভাষণের তাৎপর্য আজ কেবল তার শব্দের পুনর্বাজনার মাধ্যমে ধরার কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন লাখো মানুষের জমায়েতভরা সেদিনের সেই রেসকোর্স, তার মধ্যে স্থাপিত সেই মঞ্চ, শেখ মুজিব এলেন একটু বিলম্বে, তিনি উঠলেন মঞ্চ, চারদিকে তিনি দৃষ্টি পেললেন, দেখলেন লোকে-লোকারণ্য, শুনলেন আকাশে জঙ্গি বিমানের গর্জন এবং সেই গর্জনকেও অতিক্রম করে উঠছে উদ্বেল লাখো মানুষের সংগ্রামী আওয়াজ। দেখছেন লোক তখনো আসছে আর আসছে। আর এমনি দৃশ্য দেখতে দেখতে শেখ মুজিব বদলায়। জনতার বাইরে জন তথা ব্যক্তির এক রূপ : ক্ষুদ্র, শঙ্কিত, সীমিত। জনতার ংশ হিসেবে জনতার বাইরে জন তথা ব্যক্তির এক রূপ : তেজে কম্পমান, শক্তিতে দুর্বার আর সম্ভাবনায় অসীম।
আজকের সতের কি আঠার বছরের পুত্রদের জন্র মমতায় আমার মন ভরে ওঠে। আহা! এই দৃশ্য তারা দেখেনি। সচেতনভাবে দেখার বয়স তখনো তাদের হয়নি।
এই দৃশ্য দেখলে ৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্য বুঝতে তাদের অসুবিধা হতো না। কিন্তু সেই ৭ মার্চ তারিখে সচেতন বয়সেসর যুবক ছিল না বলেই, কিংবা ৭ মার্চের পরে জন্মগ্রহণ করেছে তাঁরাÑকেবল এ কারণেই কি তারা বঞ্চিত হবে, আজকের তরুণরা, এই দৃশ্য থেকে, আধুনিক বিজ্ঞানের অলৌকিক ক্ষমতার কৌশলের যুগে? অন দেশে এমন হয় না। অন্য দেশে প্রত্যেক যুগের সন্তানই তাদের অতীত সব মহৎ যুগকেই প্রত্যক্ষ কর এবং করে বলেই যে কোনো যুগের রক্ষা করার সংগ্রামে। আর তাই কোনো মহৎই তার কাছে অতীত নয়। সব মহৎই তার কাছে বর্তমান। কেবল আমাদের বাংলাদেশেরই অতীত মানে বিস্মৃত বিলুপ্তকাল এবং বর্তমান মানে অতীতকে অস্বীকারকারী এক যাযাবর।
৭ মার্চের ক্যাসেট ফিতাটি বাজাতে আমার দুটি প্রশ্ন মনে জাগে। একটি হচ্ছে : জনতা তথা জনতার সংগামে ব্যক্তির বা নেতার ভূমিকা। আমাদের তাত্ত্বিকরা নানাভাবে প্রশ্নটি তোলেন। তারা আলোচনা করেন। তাঁরা বলেন, কাউকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বা ‘জাতির পিতা’ ইত্যাদিবলা অহেতুক। এটা অতিশয়োক্তি। এ হচ্ছে ব্যক্তিপূজা তথা ‘পারসোনালিটি কাল্টের’ সৃষ্টি ও চর্চা। প্রশ্নটির অবশ্যই এদিক, ওদিকÑউভয়ই আছে। ব্যক্তি যখন নিজেকে জনতার প্রভু বলে গণ্য করে, যখন সে মনে করে সেই জনতাকে সৃষ্টি করেছে, জনতা তাকে নয় তখন অবশ্যই বক্তির অহংবোধের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটে। এমন অবস্থাতেই প্রকাশ পায় ব্যক্তিকাল্ট : ব্যক্তিরতি। কিন্তু এ যেমন বিকারে দিক, তেমনি জনসংগঠনের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের পশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা ঠিক যে, সংগঠনের সাংগঠনিক কমিটি থাকে। সে কমিটিতে যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। এটি হচ্ছে গণতান্ত্রিক নীতি ও পদ্ধতি। তাই সংগঠনের কৃতিত্ব-ব্যর্থতা কোনো ব্যক্তির একার নয় যৌথের কমিটির। কমিটিই হচ্ছে সংগঠনের নেতা। কিন্তু কমিটিতেও বক্ত থেকে বক্তিতে তফাৎ থাকে। কেউ অপর কারো চাইত অধিক প্রাজ্ঞ, অধিক অভিজ্ঞ*, অধিক সাহসী। কমিটির কার্যকমে এমন প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ আর সাহসীর প্রভাব থাকবেই। থাকাটাই স্বাভাবিক।একারণেই কমিটি যখন বসে তখন পাজ্ঞের কথায় আমরা অপর সকলে চমৎকৃত হই। তাকে বাহবা দিই। সাহসীর সিদ্ধান্তে আমরা আনন্দিত হই। আমরা তাকে আমাদের সম্মুখ সারিতে স্থাপন করি। তাই প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ সাহসী ব্যক্তি নেতা হয়ে ওঠেন আমাদের তথা অনুসারীদের দ্বারাই। কোনো ব্যক্তি শূন্য থেকে এসে বলতে পারে ন,া আমি তোমাদের নেতা এবং আমাদের নেতা। এমন জবর নেতৃত্ব দখল কেবল অস্তধারীর পক্ষে সম্ভব, নিরস্ত্র সংগ্রামীর পক্ষে নয়। অবশই জীবনের কোনো সত্যই দ্বন্দ্বহীন নয়। অনুসারীদের দ্বারা সৃষ্ট হয় নেতা। এবং অনুসারীদের চেতনার অভাবেই তৈরি হতে পারে ব্যক্তিনেতার ব্যক্তিরতির ভাব। তাই প্রয়োজন সদা-সতর্কতার, সদা সচেতনতার যেনো সমষ্টি বিস্মৃত না হয় নিজের মূল সৃষ্টিশীল ক্ষমতাকে এবং যেনো ব্যক্তিনেতা বিস্মৃত না হয় তার শক্তির মূল্য তথা জনতাকে। কিন্তু এতো আদর্শ অবস্থা। এটার জন্য যেমন উভয় তরফে সার্বক্ষণিক সংগ্রাম আবশ্যক, তেমন্ িরে কোনো ভান্তিতে হতাশ হয়ে জনতার শক্তি এবং বক্তির ভূমিকা, উভয়কে নাকচ করে দেওয়ার মনোভাবও থাকা উচিত নয়। এতে ক্ষতি উভয়েরই।
শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়েছিলেন নিজের ঘোষণায় নয়, সংগ্রামী জনতার সস্নেহ এবং সকৃতজ্ঞ ইচ্ছার প্রকাশে।
এ কথা অবশই ঠিক যে, শেখ ‘বঙ্গবন্ধু’ আখ্যাটিকে তাঁর সমকালীন সাথী, অ-সাথীদের সকলে যে আনন্দের দৃষ্টিতে দেখেছে, এমন নয়। অস্বাভাবিকভাবে এই আখ্যাটিতে অনেকের মনে ঈর্ষার উদ্রেক হয়েছে। তাদের মনের ভাবটি এমন : এই অঝ্ঞ লোকটিকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলার কী প্রয়োজন? এমন মনোভাবের অবচেতন অনুযোগটি হচ্ছে : আমাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ না বলে শেখকে বলা কেনো?
তাই শেখ মুজিবকে আমরা ঈর্ষা করেছি। ঈর্ষা করেছি আমাদেরকে অতিক্রম করে বড় হওয়াতে। নানাদিকে বড় : তেজে, সাহসে, স্নেহে, ভালোবাসায় এবং দুর্বলতায়। সর্বদিকে। এবং সেই ঈর্ষা থেকেই আমরা তাঁকে হত্যা করেছি। কেবল এই কথাটিই বুঝিনি যে, ঈর্ষায় পীড়িত হয় ঈর্ষিতকে হত্যা করে ঈর্ষিতের স্থান দখল করা যায় না।
আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটি এরূপ : শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণটি কি কেউ লিখে দিয়েছিলেন, তাঁর সাথী, অনুসারী, কবি, সাহিত্যিক কেউ? না কেউ লিখে দেয়নি। এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শেখ মুজিবের এই আরেক বৈশিষ্ট্য, গুণ বক্তৃতা পাঠে তাঁর আড়ষ্টতা আসত।
শেখ মুজিব তাঁর সমগ্র জীবনই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বক্তৃতা করেছেন। কখনো অপর কারো লিখিত বক্তৃতা পাঠ করেননি। তাঁর সকল ভাষণে তাই স্বতঃস্ফূর্ততার প্রকাশ : কথার অগোছালো ভাব, হযতো পুনরাবৃত্তি, কিন্তু স্বত: স্বতঃস্ফূর্ত তেজস্বিতায় ভাস্বর। এমন তেজ লিখিত ভাষণে কখনো আসতে পারে না। শেখ মুজিবের ভাষণ তাঁর মুখ থেকেই শোনা যেতো আর সেই সাক্ষাৎ শোনাতেই তার যা কিছু তাৎপর্য প্রকাশিতহতো। তাই ৭ মার্চের ভাষণ লিীখত আকারে যখন আমরা পাঠ করতে যাই, তখন তাতে তাৎপর্যময় কথা আমরা পাই, কিন্তু শেখ মুজিবকে পাই নে।
যন্ত্রকৌশল যাই হোক, নিহত শেখ মুজিবকে আর সাক্ষাৎভাবে পাওয়া যাবে না। নিহত না হলেও শেখ মুজিব মৃত্যুহীন হতেন না। তা সত্ত্বেও ৭ মার্চের ভাষণে শেষ যে বাক্যটি তিনি উচ্চারণ করেছিলেন : ‘এবারের সংগাাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধনিতার সংগ্রাম এ বাক্যটি যেমনি স্বতঃস্ফূর্ত ছিল, তেমনি তাঁর কণ্ঠে তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছিল। এ বাক্যটি বাংলাদেশের আপামর মানুষের একিেট মহৎ ইচ্ছা ও স্বপ্নের দ্যোতক হয়ে সেদিন প্রকাশিথ হয়েছিল শেখ মুজিবের কণ্ঠে : বাক্যটি যে, এবারের সংগামই স্বাধীনতার সংগ্রামÑএ সীমাবদ্ধ থাকেনি, তার সঙ্গে যে যুক্ত হয়েছিল ‘মুক্তি’ শব্দটিও, সেটিই আমাকে আজও বিস্মিত করে। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ শেখ মুজিব কথখানি ভাষাতাত্ত্বিক ছিলেন, তা আমি জানিনে। কিন্তু সংগ্রামী মুজিব অচেতনভাবে হলেও অনুভব করেছিলেন, ‘স্বাধীনতা’র চাইতে ব্যাপকতর তাৎপর্যের শ্বদ ‘মুক্তি’। স্বাধীনতার সীমা অতিক্রম করে যায় মুক্তি। স্বাধীনতার যদি ভৌগোলিক সীমা-চৌহদ্দি থাকে, মুক্তি অতিক্রম করে যায় সকল সীমাকে : মমুক্তি বঞ্চনা থেকে, মুক্তি বৈষম্য থেকে, মুক্তি শোষণ থেকে, মুুক্তি সংকীর্ণতা থেকে, ক’পমন্ডূতা থেকে, মুক্তি সকল দীনতা থেকে। মানুষের জীবনে এর চাইতে মহৎ স্বপ্ন আর কী হতে পারে। সেই মহৎ স্বপ্নই উচ্চারিত হয়েছিল সেদিনকার সংগ্রামী মানুষের নিশানবরদার শেখ মুজিবের কণ্ঠে। স্বাধীনতার সংগ্রামের শুরু এবং শেষ আছে। কিন্তু মুক্তিসংগ্রামের শুরু অবশ্য আছে : বঞ্চিত এবং শোষিত মানুষের ক্রমবর্ধমান চেতনার মধ্য দিয়ে তার শুরু। কিন্তু মুক্তিসংগ্রামের শেষ নেই। কমমুক্তির মধ্য দিয়েই অধিকতর মুক্তিপানে মুক্তিসংগ্রামের অনিবার অগ্রগমন।
১৯৭১ সালের ৭ই মাচেৃর ভাষণের শেষ বাক্য : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- তের বছর অতিক্রম করে আজও তাই নিঃশেষিত নয় তার তাৎপর্যের দিক থেকে। স্বাধীনতার পরে আসে মুক্তির তাগিদ। বাংলাদেশের তরুণ শক্তির নতুন সংগ্রামের আওয়াজও তাই আজ : এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’।
0 comments:
Post a Comment