হায়েনার রাত
শিহাব সরকার
কাকভোরে মুস্তাফিজের ঘুম ভেঙে যায়। উঠে হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ড, কোনো দিন সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড় পর্যন্ত চলে যান। তখন রাস্তা পুরো ফাঁকা থাকে। ফুটপাতে চোখে পড়ে মর্নিং ওয়াকে বেরোনো তাঁর মতো আরও বেশ কজন মাঝবয়সী পুরুষ। দু-একজন মহিলাও থাকে, ইদানীং ট্রাকসুট বা হাফপ্যান্ট-গেঞ্জি পরা কিছু তরুণও চোখে পড়ে। এরা হাঁটে না, দৌড়ায়। মুস্তাফিজের বাসায় ফিরতে ফিরতে ভোরের সাদাটে আবছায়া ছাপিয়ে শহরময় ছড়িয়ে যায় কাঁচা-হলুদ রোদ। পনেরো নম্বরের মুখ থেকে পশ্চিম দিকে চলে যাওয়া রাস্তার পাশে সস্তা রেস্টুরেন্ট, পান-সিগারেটের দোকান, মুদি দোকানগুলো খুলে যায়। রাস্তায় বিআরটিসির বাস চলতে শুরু করে, একটি-দুটি করে রিকশা নেমে যায়।
আজ অনেক রাত পর্যন্ত তাঁর ঘুম আসেনি। এ রকম হয় না সাধারণত। কী কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন না। মাথায় কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না, গুরুভোজন করেননি বা উল্টা-পাল্টা খাননি। ফলে পেট শান্ত ছিল। সর্দি-কাশি ছিল না। তবু তিনি দুই চোখের পাতা এক করতে পারছিলেন না। খুব অস্থির লাগছিল। একটা তন্দ্রাভাব আসে, তারপর হঠাৎ গরম লাগতে শুরু করে। উঠে খাবার টেবিল থেকে দুবার পানি খেয়ে এলেন। ঘুম-জড়ানো গলায় রাহেলা খানিকটা বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বলেছিলেন, তুমি কী শুরু করলে? উত্তর না দিয়ে চোখ বুজে সটান পড়ে থাকলেন মুস্তাফিজ। আরও অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করতে করতে যখন চোখের পাতা ভারী হয়ে এল, রাত তখন দেড়টা-দুটো হবে। ঘুম ভাঙল রানুর চিৎকারে। চোখ মেলে মুস্তাফিজ প্রথমে দিশেহারার মতো মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন। রানুর হাতে ট্রানজিস্টারটা। একটা ধাবত পুরুষকণ্ঠ কিছু বলছিল। মুহূর্তের মধ্যে ধাতস্থ হলেন মুস্তাফিজ, খেয়াল করলেন, মেয়ের চোখমুখ ভয়ার্ত। রানুর এরকম সন্ত্রস্ত, ফ্যাকাশে চেহারা তিনি কোনোদিন দেখেননি।
বাবা শুনছ, রেডিওতে এসব কী করছে! হতভম্ব গলায় রানু বলল। ঠিক তখনি রেডিওতে আবার সেই ধাতব কণ্ঠ ‘শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে...।’ পেটের মধ্যে যেন একটা বরফের চাঙড় গুঁড়িয়ে গেল, সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে মুস্তাফিজের, দুঃস্বপ্ন দেখছেন না তো? না, ঐ তো জানালা দিয়ে ভোরের রোদ এসে টেবিলটা ভাসিয়ে দিয়েছে, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ঘরের প্রতিটি বস্তু। স্বপ্নে এরকম দেখা যায় না। তিনি উঠে বসলেন। তবু সবকিছু অবিশ্বাস্য আর অলীক মনে হয় তাঁর, কী আবোলতাবোল বকছে। রানু এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। এবার টেবিলের সঙ্গে রাখা চেয়ারটায় বসে ট্রানজিস্টারের ভলিউম বাড়িয়ে দেয়, ‘বাবা এসব কী বলছে? তুমি কিছু বুঝতে পারছ না?’ রানুর গলা ক্ষীণ হয়ে আসে। এতক্ষণে রাহেলা উঠে বসেছেন। রেডিওর কথাগুলো তাঁর কানে যাওয়ামাত্র তিনি বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে উঠলেন, হায় আল্লাহ। এসব কী শুনতাছি? রানুর আব্বা, বড় রাস্তায় গিয়া দেখেন না কী ঘটল। রাহেলা মেয়ের পাশে গিয়ে ট্রানজিস্টারে হাত রাখেন।
একটা ধূসর নিশ্চেতনার কূপে তলিয়ে যাচ্ছিলেন মুস্তাফিজ। স্ত্রীর কথায় তিনি ধুলো-কাদার বাস্তবে উঠে আসেন। এবার তিনি রেডিওর কথাগুলো পরিষ্কার বুঝতে পারেন। তাঁর সামনে কোনো ধোঁয়াশা থাকে না। তবু মেইন রোডে গিয়ে অবস্থা বুঝে আসা উচিত। ঘটনা বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু তিনি নড়তে পারছেন না। হঠাৎ শরীরটা জগে গেছে যেন। ঠাণ্ডা পাথর। এই তো সেদিন বঙ্গবন্ধু এক বক্তৃতায় বলছিলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, আমি হয় তো থাকব না...ভাইয়েরা, হুঁশিয়ার থাকবেন...।’ কথাগুলোর মর্ম হয়তো কেউ বোঝারই চেষ্টা করেনি। ভেবেছে, বঙ্গবন্ধু এরকম সব সময় বলে থাকেন। বাহাত্তরের দশই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার কয়েক মাসের মধ্যেই মুস্তাফিজ টের পেয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর চারদিকে চক্রান্তের জাল ছড়ানো হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে তথাকথিত মুসলিম বাংলা আন্দোলনের ব্যাপারটিকে তিনি হালকাভাবে নেননি। ঢাকা শহরের দেয়ালেও এর চিকা পড়েছিল। ওটার প্রকোপ একসময় কমে আসে, অস্থিরতার বীজ ছড়ানো হতে থাকে অন্য কৌশলে।
বাবা, তুমি বিশ্বাস করছ, রেডিওর কথা? আজ বঙ্গবন্ধু ইউনিভার্সিটিতে যাবেন দশটারসময়, তাঁকে ডক্টরেট দেওয়া হবে... আর বলে কিনা...। রানু অবিশ্বাসী গলায় বলল।
যান না রাস্তায়। কিছু তো বুঝতে পারতেছি না। হতবিহ্বলভাবে রাহেলা বললেন।
ট্রানজিস্টারের পাশে টেবিলঘড়িটায় চোখ পড়ল মুস্তাফিজের। সাড়ে আটটা বাজে। মুস্তাফিজ খাট থেকে নেমে বাসার পাশের গলিটায় একটা চক্কর দিয়ে এলেন। রাস্তায় লোকজন কম। অনেক দোকানের ঝাঁপ খোলেনি। অল্পবয়সী কাজের বুয়া ধরনের এক যুবতী ছুটতে ছুটতে বলে গেল, সব শ্যাষ কইরা ফালাইছে। শ্যাখ, শ্যাখের পোলা-মাইয়া সব। হায় আল্লাহ্! কী হইব অহন! আর এগোননি মুস্তাফিজ। ঘটনা তাঁর কাছে মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেছে। মুজিব ভাই যে শত্রুর কথা কিছুদিন থেকে বারবার নানা বক্তৃতায় বলছিলেন, তারাই তাঁকে হত্যা করেছে। তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। হয়তো এর পেছনে আছে আমেরিকা বা পাকিস্তানের এদেশি এজেন্টরা। এ হত্যাকাণ্ড শুধু তাঁর নয়, স্বাধীন সত্তা নিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেওয়া বাংলাদেশের সমস্ত বাঙালির। শত্রুরা একটা জাতির সমস্ত সম্ভাবনা অঙ্কুরেই মেরে ফেলল। বারান্দায় পা রাখা মাত্র রানু বলল, বাবা শোনো, বলছে ‘রেডিও বাংলাদেশ! বাংলাদেশ জিন্দাবাদও বলছে।’
ও ট্রানজিস্টারটা নিয়ে ড্রইংরুমে চলে এসেছে। বোধহয় বেশিক্ষণ হয়নি রানু ঘুম থেকে উঠেছে। মুখটা ফোলা ফোলা। অবিন্যস্ত চুলের কয়েক গাছি কপালের ওপরে এসে পড়েছে। অন্যদিন ওর চেহারাটায় এ সমস্ত সতেজতা থাকে। আজ ঐ সজীব ভাবটা নেই। ওর উজ্জ্বল শ্যাম ত্বকের ওপর হালকা ধূসর ছায়া, চোখ দুটো ছলছল করছে। মেয়ের মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে মুস্তাফিজ বললেন, রানু, সব গেল। নয় মাসের এত বড় একটা যুদ্ধ, গণহত্যা, এত দুঃক, এত আনন্দ, সব মিথ্যা হয়ে গেল।
বাবা, বঙ্গবন্ধু কিছু বুঝতে পারেননি? রানু ট্রানজিস্টারটা ছোট টেবিলে রেখে বলল।
বুঝতে কি আর পারেননি? বায়ান্ন সাল থেকে তাঁকে চিনি। উনি সব বুঝতেন। উনি মানুষের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলে দিতে পারতেন, লোকটার মনে কী আছে। কিন্তু ঐ যে তাঁর মনটা, হৃদয়টাÑ এমন বিশাল মানুষ। কী করে মানুষকে অবিশ্বাস করেন। তাঁর ভালোবাসা সব যুক্তিকে ছাপিয়ে যেত। বলতেন, বাঙালি তাঁর কোনো ক্ষতি করবে না। এমন একটা খোলা বাসায় থাকতেন! কত কাজের লোক তাকে বলেছে, মুজিব ভাই, বঙ্গভবনে চলে যান। এভাবে থাকা আপনার জন্য ঠিক না। উনার সেই এক কথা। বাঙালি তাঁকে মারবে না।
মুস্তাফিজ হঠাৎ থেমে গেলেন। হাঁটুতে কনুইয়ের ভর দিয়ে এক হাতে মাথা চেপে ধরলেন। এখান থেকে রাহেলাকে দেখা যাচ্ছে। গালে হাত দিয়ে নিশ্চল মূর্তির মতো কাঠের চেয়ারটায় বসে আছেন। রানু হঠাৎ খেয়াল করল, হাঁটুর কাছে বাবার লুঙ্গিটায় টপটপ করে পানি ঝরছে। বাবা কাঁদছেন। এই চার বছরে বাবা দ্বিতীয়বার কাঁদলেন। একাত্তরের নভেম্বরে তিনি এভাবে এক হাতে কপাল চেপে ধরে প্রথম ফুঁপিয়ে, পরে বাচ্চা ছেলেদের মতো কেঁদে উঠেছিলেন। ঐদিন সকালে খবর এসেছিল, ভাইজান মুগদাপাড়ার কাছে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। একমাত্র ছেলের মৃত্যুর খবর বাবা সইতে পারেননি। সারা দিন মেয়ে এবং স্ত্রীকে সামলে, নানাভাবে সান্ত্বনা দিয়ে সন্ধ্যাবেলা তিনি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি। কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।
রানুর গলার কাছটা টনটন করছে। মা ভাবলেশহীন চোখে বেডরুম থেকে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন। রানু ট্রানজিস্টার অফ করে দেয়। বাবার ফোঁপানির শব্দ পাওয়া যায়। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। রানু উঠতে যাচ্ছিল। মুস্তাফিজ মুখ তুললেন। পরনের গেঞ্জি দিয়ে চোখ মুছে উনি ইশারায় রানুকে বসতে বললেন। তারপর ড্রইংরুমের দরজার কাছে গিয়ে ভাঙা গলায় বললেন, কে?
চাচা, আমি মানিক।
মানিক ওঁর ভাইপো। হলে থাকে। মুস্তাফিজ দ্রুত দরজা খুললেন। উ™£ান্ত, ঝড়ে পড়া কাকের চেহারা নিয়ে মানিক ঘরে ঢোকে। মুস্তাফিজ সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে ভাইপোর দিকে ফিরে বললেন, খবর কী রে মানিসক?
রেডিও শোনেন নাই? মানিক একটা সোফায় শরীর ছেড়ে দিল। হাঁপাচ্ছে।
শুনেছি। সব সত্য?
মানিক কিছু না বলে মাথা ঝাঁকায়। মুস্তাফিজ ওর মুখোমুখি সোফাটায় বসলেন। রাহেলা ঘরে ঢোকেন। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মানিকের দিকে চেয়ে থাকেন।
মানিক ভাই, এটা বিশ্বাস করা যায়? তুমি কি দেখলে? ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েনি? মিছিল হচ্ছে না? রানু মানিকের সামনে এগিয়ে এসে কোমরে দুহাত রেখে দাঁড়ায়।
মানক রানুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কয়েক পলক। তারপর বলল, ইউনিভার্সিটিতে ট্যাঙ্ক গেছে। কামানের সামনে কে প্রোটেস্ট করবে?
কেন করবে না? আমি হলে ট্যাঙ্কের সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে, আর কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না। রানুর গলা চড়ে যাচ্ছে। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ও সোফায় বসে পড়ে। রাহেলা বসছেন স্বামীর পাশে।
প্রোটেস্ট হবে, রানু। অবশ্যই হবে। আসলে মানুষ হতভম্ব হয়ে গেছে। শোকে-বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেছে। অনেকে রেডিও শুনেও বিশ্বাস করতে পারছে না। আমারও তো বিশ্বাস হচ্ছে না। মানিক সবার দিকে একবার চোখ বোলাল।
সেই কবে আলেকজান্ডার ভারতবর্ষকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘সত্যি সেলুকাস...!’ বাংলাদেশ তো ভারতবর্ষের বাইরে ছিল না। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু হয়তো বিশ্বাস করতে চাইতেন না, কিন্তু কিছু কুলাঙ্গার মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছিল। দেশ মুক্ত হওয়ার পর এরা লাগে বঙ্গবন্ধুর পেছনে। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অপদস্থ করার জন্য কত রকম প্রচারই না করেছে। মানুষকে মিথ্যা কথা বলে উসকে দিয়েছে। তিলকে তাল করেছে। মীরজাফরের দল! বিড়বিড় করে বলে যান মুস্তাফিজ। মাথা পেছন দিকে হেলানো। মুখটা কিঞ্চিৎ হাঁ-করা।
মানিক, তুই খবরটা কেমনে শুনলি? রাহেলা মানিকের দিকে খানিকটা ঝুঁকে গিয়ে বললেন।
ওই তো চাচি, রেডিওতে। আমার পাশের রুমে রেডিও আছে। ভোরবেলা শুনি বারান্দায় চিৎকার, হইচই। বাইরে এসে শুনি বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে। পাঁচ তলায় আমার রুম থেকে কাঁটাবনের পাশে বড় রাস্তাটা দেখা যায়। দেখলাম, একটা ট্যাঙ্ক যাচ্ছে পূর্ব দিকে। রাত দুইটা পর্যন্ত ছিলাম ডাকসু অফিসে। আজ বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে ছাত্ররা রিসিপশনস দেবে, সে নিয়ে কত প্ল্যান-প্রোগ্রাম। ভিসি স্যারের বাসাতেও রাতে মিটিং হয়েছে। কে জানত, ভোরবেলা ওটা শুনব? মানিকের মুখের পেশিগুলো বেঁকেচুরে যায়। ও নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে।
এই মুজিব ভাইয়ের জন্য আমি একাত্তর সালে রোজা রাখছি। নামাজের পর আল্লাহ্র কাছে হাত তুইলা দোয়া করছি, মাবুদ, তুমি মুজিব ভাইরে সহি-সালামতে দেশে ফিরাইয়া আনো। আমি একলা না। আমার মতো লাখ লাখ মানুষ তাঁর জন্য দোয়া করছে। সেই দোয়া তো আল্লাহ্ কবুল করছিল। তাইলে রানুর আব্বা, ক্যান এইটা হইল? ক্যান...ক্যান...?
দুই দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে মুস্তাফিজ অস্ফুট গলায় বললেন, জানি না, রাহেলা।
মা, আমার জাতি হিসেবে খুব অধৈর্য। নর্থ বেঙ্গলে আকাল দেখা দিয়েছে। কিছু অভাবী মানুষ ঢাকার রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। আর অমনি বলা শুরু হলো, দুর্ভিক্ষ। না খেয়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। এ জন্য দায়ী দেশের কিছু পত্রিকা আর কিছু বিদেশী সাংবাদিক। কাগজগুলোতে কত উদ্ভট কথাই না লেখা হয়েছে। এগুলো পড়ে কিচু মানুষ বলা শুরু করল, সরকার কিছু করতে পারছে না, দেশ চালাতে পারছে না। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, আমি তিন বছর কিছু দিতে পারব না। তাঁকে সেই টাইমটুকুও আমরা দিলাম না। ভেবেছি, দেশ স্বাধীন হয়েছে, এখন আমাদের নদীগুলো দিয়ে দুধের নহর বইতে থাকবে। অক্টোবর রেভ্যুলিউশনের পর রাশিয়ায় পুরো স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে কতগুলো বছর লেগেছে? বলো তোমরা, কতগুলো বছর? রানু কথাগুলো ঠিক কাকে উদ্দেশ করে বলছে, বোঝা যায় না। এ ঘরে এই মুহূর্তে এসব না বললেও চলে। কিন্তু মুস্তাফিজ বুঝলেন, রানুর ভেতরে সকাল থেকে দুঃখ, শোক আর হতাশার চাপ বেঁধে রয়েছে। এসব বলে ও নিজেকে হালাক করতে চায়। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী ও। এ ধরনের কথা ও সভা-সমিতিতে নিয়মিত বলে যাচ্ছে। ঘরে ও আপন মনে থাকে। রেডিও শোনে, বই পড়ে। শোকের ধাক্কায় আজ ওরা সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
বাবা, আমি এ দেশে থাকব না। আমার ঘৃণা হয়। বঙ্গবন্ধুকে আমরাই মেরেছি। রানু উঠে দাঁড়াল।
মানিক রানুর মাথায় আলতো করে হাত রেখে বলল, বোনটি, মানুষ কী করবে বালো? ওদের উল্টা-সিধা বোঝানো হয়েছে। দিনের পর দিন প্রপাগাণ্ডা চালানো হয়েছে বঙ্গবন্ধু দেশের সবকিছু ইন্ডিয়াকে দিয়ে দিচ্ছেন, তিনি ইন্ডিয়ার কথা অনুযায়ী চলছেন।
কী জঘন্য মিথ্যা! বঙ্গবন্ধুর দেশে ফিরেই ইন্ডিয়ান আর্মিকে দেশে ফেরত পাঠালেন। ফারাক্কার পানি দাবি করলেন। এই সেদিন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ উল্টা-পাল্টা কী যেন লিখল, বঙ্গবন্ধু এ দেশে আনন্দবাজার আসা বন্ধ করে দিলেন। বঙ্গবন্ধু কারও খবরদারি সহ্য করার মানুষ? ওঁকে আমি ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্টের সময় থেকে চিনি। একসঙ্গে জেল খেটেছি। উনি চলবেন এর কথায় ওর কথায়? সব মিথ্যেবাদী হারামখোরের দল। মুস্তাফিজ বললেন।
মানিক ভাই, আমি এ দেশে থাকব না। যে দেশের মাটি বঙ্গবন্ধুর রক্তে ভিজেছে, সে দেশ অভিশপ্ত, সে দেশে থাকা যায় না। তুমিও চলো। রানু দূরের একটা সোফায় বসে বলল।
মা গো, দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েই কি শান্তি পাবি? তোর পলিটিকস তোকে কী শিখিয়েছে? পালায় কাওয়ার্ডরা। একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চের পটর সবাই যখন পালাচ্ছিল, বঙ্গবন্ধু ঠায় বসে ছিলেন তাঁর বাসায়। জীবনের কোনো মায়া না করে বসে ছিলেন। পালাবার কথা ভাবিস না। মুস্তাফিজ স্নেহে মেয়ের দিকে তাকালেন।
Ñবাবা, আমি পালাবার কথা বলছি না। আমি বলছি, বঙ্গবন্ধুর রক্তে ভেজা মাটিতে আমি থাকতে পারব না।
Ñপারতে হবে। খুনিদের উল্লাস একদিন না একদিন থামবেই। আমার কথা মনে রাখিস। দশ, পনোরো, বিশ বছর পরে হলেও বঙ্গবন্ধুর নামে মানুষ আবার রাস্তায় মিছিল করবে। তাঁর ছবি অফিস-আদালতে আবার উঠবে। আমি হয়তো তখন বেঁচে থাকব না। হয়তো এই খুনিরাই আমাকে মেরে ফেলবে। সে অন্য কথা। হাল ছাড়বি না। বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন সত্যের জন্য লড়াই করেছেন। সত্যের মৃত্যু নেই। বলতে বলতে মুস্তাফিজ উঠে দাঁড়ালেন। তাঁকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। ঘরে পায়চারি করলেন কয়েকবার। দরজা খুলে বাইরের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। তারপর রানুর দিকে ফিরে বললেন, মা, আমার পাঞ্চাবিটা নিয়ে আয়।
কোথায় যাচ্ছ তুমি? তুমি কিন্তু মুখ ধোওনি। রাহেলা উঠে দাঁড়ালেন।
ও। আর মুখ ধোওয়া! মুস্তাফিজ বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন।
মানিক, তুই এত দূর এলি কীভাবে? রাহেলা মানিকের দিকে তাকালেন।
চাচি, রাস্তায় হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে না। আপাতত মনে হয় সবকিছু স্বাভাবিক। বাস-রিকশা সব চলছে। আমি বাসে এসেছি।
ও। কেউ কিছু বলছে না? রাহেলার গলা চিরে গেল্
না চাচি, কিছু বলছে না। কিন্তু মানুষের চোখ সবকিছুই বলছে। ও চোখে আছে আতঙ্ক আর আতঙ্ক। মানুষ যেন বোবা হয়ে গেছে। মানুষের এ চেহারা আমি দেখেছি একাত্তরের মার্চ-এপ্রিল মাসে। কী বলবে মানুষ? কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয়, কেউ যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে জোরে একটা স্লোগান দেয়, হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে। কোথায় সেই মানুষ?
রানুর চোখেমুখে বিদ্রƒপ খেলে গেল। গলায় ওর ভেতরে জমানো সমস্ত শ্লেষ ঢেলে ও বলল, কোথায় তোমাদের বিপ্লবী ছাত্রনেতারা! আমরা না হয় ছাত্র ইউনিয়ন করি। কিন্তু তোমাদের মধ্যে কি এমন কোনো নেতা-কর্মী নেই যে আবার একটা যুদ্ধের ডাক দিতে পারে? আমি তো মনে করি আজ... কত তারিখ, আম্মা? চৌদ্দ...পনেরো...হ্যাঁ, পনেরো...পনেরোই আগস্ট, আরেকটা ক্র্যাকডাউন হলো বাঙালিদের ওপর। এখন এমন কেউই নেই যে এ হত্যার প্রতিবাদ করে? তুমি আমাকে এটা বিশ্বাস করতে বলো, মানিক ভাই? বঙ্গবন্ধু কাদের ওপর ভরসা করে এ দেশের হাল ধরেছিলেন? অল কাওয়ার্ডস।
মানিক মুখ ঘুরিয়ে থাকে। ওর বলার কী আছে? সত্য কথা হচ্ছে, ছাত্রদের মধ্যে ভোরে বেশ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ক্যাম্পাসে ট্যাঙ্ক ঢোকার পর সে উত্তেজনা মিইয়ে যায। ট্যাঙ্কের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র ছাত্ররা কী করতে পারে? বরং হলগুলোতে একটা চাপা ভীতি ছড়িয়ে পড়েছিল। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অনেকেই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে। মানিকও হলে থাকা নিরাপদ মনে করেনি। ও হল ছাত্রলীগ শাখার সাংস্কৃতিক সম্পাদক। ও বুঝতে পেরেছিল, ওর জন্য হলে থাকা একদম নিরাপদ নয়। কিন্তু রানুর কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়। শরীর গরম হয়ে ওঠে। এভাবে চাচাতো বোনের ওড়নার নিচে বসে ও বঙ্গবন্ধুর এই মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নেবে? রানু মিথ্যে বলেনি, বঙ্গবন্ধুর রক্তে ভেজা মাটিতে বেঁচে থাকার মানে নেই। যদি বাঁচতে হয়, সত্যি কথা বুক ফুলিয়ে বলতে হবে। ও টিএসসির সড়কদ্বীপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলবে, এই সব খুনি, যারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে, তারা বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের কলঙ্ক। বাঙালি তাদের কখনো ক্ষমা করবে না। ভাইয়েরা, আসুন আমরা এই ঘৃণ্য খুনিদের রুখে দাঁড়াই। বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। তাঁর জন্য আমরা প্রাণ দিতে পারব না? ভাই ও বোনো, বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের অংশ বানাবার চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে। মাত্র চার বছর আগে আমরা হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন কিেরছি। তিরিশ লক্ষ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছে। বাংলাদেশ আবার সেই পাকিস্তানে ফিরে যাবে?
বলুন, আপনারা আবার পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলবেন? খুনিরা বলছে, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। ওরা আমাদের প্রাণের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ মুছে দিতে চায়। আপনার বলবেন বাংলাদেশ জিন্দাবাদ? বলুন আমার সঙ্গে, জয় বাংলা। জয় বাংলা। শেষ শব্দটা জোরে বেরিয়ে এসেছে। রাহেলা চমকে তাকালেন মানিকের দিকে। রানুও। ও বলর, মানিক ভাই, কী হলো?
কিছু না। আমাকে এক গ্লাস পানি দে। মানিক রানুর দিকে তাকিয়ে বলল। ওর ফরসা মুখটা রক্তবর্ণ দেখাচ্ছে। রানু দৌড়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এল। সেটা ঢকঢক করে খেয়েই মানিক উঠে দাঁড়াল।
কোথায় যাচ্ছ? রানু বলল।
ক্যাম্পাসে। আমি প্রতিরোধের ডাক দেব। মানিক দরজায় সিটকিনি খুলে বারান্দায় চলে গেছে।
-কী পাগলামি করছ, মানিক ভাই? আমি ওসব সিরিয়াসলি বলিনি। আর তোমাকে উদ্দেশ্য করে আমি কিছুই বলিনি। আসো। ভেতরে আসো। তোমাকে ওরা গুলি করে কুকুরের মতো মারবে। এভাবে বেঘোরে মরার অর্থ হয় না। রানু মানিকের হাত চেপে ধরে।
-বেঘোরে না, রানু। আমি বঙ্গবন্ধুর জন্য মরতে যাচ্ছি। আমার জন্য দোয়া করিস। মানিক ছুটে বেরিয়ে গেল্
ড্রইংরুম আর বেডরুমের মাঝখানের দরজায় দাঁড়িয়ে মুস্তাফিজ দেখেছিলেন মানিকের যাওয়ার দৃশ্য। শহরটা যেন এক রাতের ব্যবধানে সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। সবকিছু অচেনা লাগে। গতকাল রাস্তার দু’ধারের গাছগুলোর যে রং দেখেছিলেন, আজ যেন তা অনেকটা মুছে গেছে। গাছে সবুজ নেই, তার জায়গায় ধূসরতা জেগে উঠেছে। মানুষগুলোও অন্যরকম। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সবাই দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। গুলিস্তানের এই জায়গাটা বাস-ট্রাকের হর্ন, নানা ধরনের মাইক আর মানুষের হই-হট্টগোল চিৎকারে গরম হয়ে থাকে। পারতপক্ষে মুস্তাফিজ এদিকে আসেন না। দম বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু আজ ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এটার কারণ কান ফাটানো শব্দপুঞ্জও নয়, এক অস্বস্তিকর নৈঃশব্দ্য। এ কল্পনা করা যায় না। মুস্তাফিজের মনে হলো, আজ যেন গাড়িগুলো হর্ণ দিচ্ছে না, রিকশাগুলো বেল না বাজিয়ে চলে যাচ্ছে, হকারদের মাইক নেই এ গুলিস্তান তিনি কখনো দেখেননি। বিআরটিসির যাত্রীছাউনিতে একটা সিমেন্টের বেঞ্চে বসে থাকেন মুস্তাফিজ। অনেকগুলো বাস সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি ঢাকার বাইরে কোথাও যাবার জন্য এসেছেন, কিন্তু কোন দিকে যাবেন বুঝতে পারছেন না।
বাসা থেকে বেরিয়ে একবার ভেবেছিলেন, বত্রিশ নম্বরের দিকে যাবেন। পাঁচ নম্বর রোড ছাড়িয়ে যেতে কিছুদূরে ফুটপাতে এক চা-দোকানের সামনে জটলা দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। উনি কাছে গেলেন না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করলেন, লোকগুলো কী নিয়ে বলাবলি করছে। নিচুস্বরে কথা বলার জন্য প্রথমে মুস্তাফিজ কিচু বুঝতে পারলেন না। শুধু শেখ মুজিব, শেখ সাহেব, বঙ্গবন্ধু এ শব্দগুলো কানে আসে। একজন মাঝবয়সী কামলাগোছের লোক বত্রিশ নম্বরের দিকে ছুটতে ছুটতে আসছিল। লোকটা ভিড় দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর জোরে বলে উঠল, সব শ্যাষ। মুজিবের বাড়িতে কেউ বাঁইচা নাই। সবাইরে মাইরা ফালাইছে। আমি শ্যাখ সাহেবরে কাইলও দেখছি। গাড়িতে বইসা আছে। এইটা যদি জানতাম, তাইলে উনারে একটু ভালো কইরা দেইখা লইতাম। কোন্ ফেরাউন তাঁরে, তাঁর পরিবাররে মারল, ভাই আমারে বুঝান। লোকটা রাস্তার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বলতে থাকে, খোদার গজব নামব এই দ্যাশে। সব পুইড়া ছারখার হইব। দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চ থেকে উঠে এক বৃদ্ধ লোকটাকে জোর করে বসিয়ে দেয়। ফিসফিস করে কিছু বলে। লোকটা চুপ করে যায়।
মুস্তাফিজ বহু কষ্টে পা টেনে ওখান থেকে চলে এলেন।
তাহলে সকালে বাসার পাশে রাস্তায় মহিলা চিৎকার করে যে কথাগুলো বলছিল, তা সত্যি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির সবাইকে মেরে ফেলেছে? কামাল, জামাল, বেগম মুজিব, হাসিনা, রেহানা সবাইকে? কামালের বিয়ের দিন দেখেছিলেন বালক রাসেলকে। কী নিষ্পাপ আর মায়া-মায়া চেহারা! তাঁর মনে হয়েছিল, রেহানার সঙ্গে ওর চেহারার মিল আছে। কেন জানি ঐদিন ছেলেটাকে মনোযোগ দিয়ে তিনি লক্ষ করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, এ ছেলে একদিন খুব বিখ্যাত হবে। ওর চোখেমুখে একজন ভবিষ্যৎ বড় মানুষের আদল আছে। এখন শুদু ও বেঁচে থাকলে হয়। শিশু বলে ওকে নিশ্চয়ই মারেনি।
হাঁটতে হাঁটতে সায়েন্স ল্যাটরেটরির কাছে আসতে মুস্তাফিজের মনে হলো, আরে! হাসিনা তো দেশের বাইরে। স্বামীর সঙ্গে ইউরোপের কোনো দেশে আছে। খুব সম্ভব রেহানাও সঙ্গে আছে। এ খবরটা তাঁকে দিয়েছিল মানিক। শেখ কামালের সঙ্গে ওর পরিচয় ঢাকা কলেজে পড়ার সময় থেকে। মানিক এক বছরের জুনিয়র। মানিকের মাধ্যমে মুস্তাফিজ বঙ্গবন্ধুর বাসার খবরাখবর নিতেন। একটা বিদ্যুতের থাম ধরে দাঁড়িয়ে পড়লেনতিনি। তারপরস্বস্তির লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লেন। অন্তত হাসিনা আর রোহনা বেঁচে থাকুক। পঁচাত্তরের পনোরোই আগস্টের গুমোট দুপুর স্তম্ভিত, ভীতসন্ত্রস্ত শহরের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মুস্তাফিজ যেন ভবিষ্যতের একটা ঝলক দেখতে পেলেন। যদিও ভেতরে থেকে ক্রমাগত বিষাদ পাক খেয়ে উঠছে, হতাশায় ছেয়ে যাচ্ছে সমস্ত চিন্তা, পুরোপুরি ভেঙে পড়ার কারণ নেই। একদিন, সে কবে তিনি জানেন না, হাসিনা অথবা রেহানা এ দেশের হাল ধরবে। গৃহবধূ থেকে রাজনীতিবিদ হওয়ার নজির এ উপমহাদেশে আছে। সিংহলের শ্রীমাভো বন্দরনায়েক কোনোদিন ভাবতে পেরেছিলেন, তিনি পলিটিকসে জড়িয়ে পড়বেন, তারপর হবেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী? তাঁর স্বামী নিহত হয়েছিলেন আততায়ীর গুলিতে। আর হাসিনা-রেহানার বাবা-মা সহ বোধ হয় প্রায় সবাই। মুস্তাফিজের মনটা বিষণ্নতায় ছেয়ে যায়। বাবা, মা এবং ভাইদের নৃশংস মৃত্যুর খবরটা ওদের কে দেবে? কীভাবে দেবে? বিদেশের মাটিতে দুটি বোন গলা জড়াজড়ি করে কাঁদবে, ওদের সান্তাবনা দেওয়ার জন্য নিকটজন কেউ থাকবে না। মুস্তাফিজ যেন দুই বোনের বুক ফাটা বিলাপের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। তাঁর চোখ ছলছল করে ওঠে।
গুলিস্তানের বাসে উঠে মুস্তাফিজের মনে হলো, তাজউদ্দীন, নজরুল ইসলাম, শেখ মনি এদের খবরটা নেওয়া দরকার। বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে মারা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে এরাও বেঁচে নেই। এখন যারাই আসবে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালির জাতিসত্তার সব চিহ্নমুছে ফেলতে চাইবে। মানিককে অন্য সবার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। হলে অনেক খবর যায়, সেগুলো সাধারণ মানুষ জানতে পারে না।
যাত্রীছাউনিতে তেমন মানুষ নেই। প্রায় সব বেঞ্চিই ফাঁকা। মুস্তাফিজ যেটায় বসেছেন, তার ঠিক পাশেরটায় লালসালু জড়ানো এক সাধু এসে বসেছে। ওর হাতে ঝুনঝুনি বাঁধা একখানা লাঠি। লোকটা কিছুক্ষণ পরপর মাটিতে লাঠিখানা ঠুকছে, আর বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য ভাষায় কিছু বলছে। কাঁচা-পাকা দাড়িগোঁফে ঢাকা মুখ, মাথায় লালসালুর পাগড়ি। সাধুর বয়স বোঝা যায় না।
ইত্তেফাকের দিক থেকে লোকজন এদিকে ছুটে আসছে। মুস্তাফিজ উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চাইলেন। এক ঝালমুড়িঅলা দৌড়ে যাত্রীছাউনিতে এসে উঠল। এগিয়ে গিয়ে ওর কাছে মুস্তাফিজ জানতে চাইলেন, ঘটনা কী। লোকটা বলল, গণ্ডগোল হইতাছে। অবস্থা ভালো না। এইখান থাইকা যান গিয়া, মিয়া সাব।
সামনেই একটা নারায়ণগঞ্জের বাস ছেড়ে যাচ্ছিল। মুস্তাফিজ সেটায় ওঠে বসলেন। এ শহরে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে।
মাসদাইরে যে বন্ধুটির বাসায় গিয়েছিলেন, তাকে পেলেন না মুস্তাফিজ। কিছুক্ষণ এলোমেলোভাবে ঘুরে তিনি টার্মিনালে চলে এলেন। তাঁর পরিচিত এলাকা। এখান থেকে বহুবার স্টিমারে চেপে খুলনায় গ্রামের বাড়ি গেছেন। নারায়ণগঞ্জ শহরটাও তার ভালো করে চেনা। এখানকার তোলারাম কলেজে পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি সালে ছাত্র পড়িয়েছেন। তখন ছয় দফা আন্দোলন তুঙ্গে। মুস্তাফিজ শহরে ছাত্রদের নিয়ে মিছিল করেছেন, মিটিংয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। কী উত্তাল সময় ছিল ওটা। প্রায়ই হরতাল ডাকা হতো। সেসব দিন মুস্তাফিজ ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে আসতে পারতেন না। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন। নওয়াবপুর রোডে আওয়ামী লগি অফিসেও যেতেন। মুজিব ভাই ভিড়ের মধ্যে তাঁকে দেখামাত্র কাছে ডাকতেন। কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলন নিয়ে কথাবার্তা বলার ফাঁকে ফাঁকে তাঁকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করতেন। সাতান্ন কি আটান্ন সালে মুজিব ভাই দুবার গিয়েছিলেন মুস্তাফিজের বাসায়। রায়েরবাজার এলাকায় যেখানে তাঁর বাসা, সেটা তখন পুরোপুরি গ্রাম। মুজিব ভাই খুব পছন্দ করেছিলেন জায়গাটা। একবার পুরো দিন কাটিয়েছিলেন তাঁর বাসায়। বিকেলের দিকে আশপাশের লোকজন টের পেয়ে যায় এ বাসায় তাঁর উপস্থিতির কথা। সে ভিড় সামলাতে গিয়ে বেশ কষ্ট হয়েছিল মুস্তাফিজের। মুজিব ভাই রানু আর বড় ছেলে কায়সারকে খুব আদর করতেন। ওরা তখন একেবারেই শিশু। বাহাত্তর সালে মুজিব ভাইয়ের বাসায় ড্রইংরুমে কায়সারের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হওয়ার খবরটা দিয়েছিলেন মুস্তাফিজ। কিছুক্ষণের জন্য থ হয়ে বসেছিলেন মুজিব ভাই। তারপর বন্ধুর কাছে এসে বসে কাঁধে হাত রেখেছিলেন, ‘কায়সার না নাম? দেখতে আমার কামালের মতোই ছিল। আহ হা, এমন সোনার টুকরা ছেলেটা। ভাবিকে নিয়া একদিন আসছিল তো এ বাসায়।’ মুজিব ভাই জোরে জোরে দু’দিকে মাথা নাড়ছিলেন। যেন কায়সারের মৃত্যুর ব্যাপারটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। রানুকেও খুব আদর করতেন মুজিব ভাই। ওকে দিয়ে রায়েরবাজারের বাসায় এক দুপুরে চুলে বিলি কাটিয়েছিঠলেন। তারপর ওর কচি গলায় শুনেছিলেন রবীন্দ্রসংগীত। রানু গেয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা...।’ যাওয়ার সময় রাহেলাকে বলে গিয়েছিলেন, ভাবি, মেয়েকে গান শেখান। সমস্যা হলে বলবেন, আমি ব্যবস্থা করব। তারপর মুস্তাফিজের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, একটা গানের মাস্টার রাখতে পারবা না? কী মমতা আর সহানুভূতি ছিল সে গলায়। উনি বুঝতেন, কলেজের একজন সামান্য শিক্ষকের জন্য মেয়ের গানের মাস্টার একধরনের বিলাসিতা। মুস্তাফিজ হেসে ঘাড় কাত করেছিলেন। মুজিব ভাইয়ের কাছে দেওয়া কথা অনুযায়ী তিনি রানুর জন্য গানের টিচার রেখেছিলেন। পলিটিকসে জড়িয়ে গিয়ে রানুর শেষ পর্যন্ত গান গাওয়া হয়ে ওঠেনি। কিন্তু অল্প দিনে তরুণ শিল্পী হিসেবে ওর যথেষ্ট নাম হয়েছিল। নিয়মিত রেডিওতে গাইতে শুরু করেছিল।
টার্মিনাল ফাঁকা। একটা-দুটো লঞ্চ যাচ্ছে। নৌকার মাঝিদের হাঁকডাক শোনা যায় না। নদীতে নৌকাও তেমন নেই। টার্মিনালের এদিকে-ওদিকে কিছু মানুষ জটলা বেঁধে বসে চাপা গলায় কথা বলছে। আসার যাত্রী কম। যাওয়ার যাত্রীরা ভাবলেশহীন মুখে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে। মুস্তাফিজ বেশ অনেকদিন পর এলেন টার্মিনালে।একটা প্রিয় জায়গা ছিল তাঁর, সেখান থেকে শীতলক্ষ্যার একটা চমৎকার দৃশ্য পাওয়া যেত। জায়গাটা খুঁজে পেলেন না মুস্তাফিজ। বোধ হয় দোকানগুলোর আড়ালে পড়ে গেছে। ঢাকা ফিরে যাওয়ার আগে কলেজের পুরনো কলিগের বাসায় আরেকবার ঘুরে যাবেন কি?
বাসায় কলিগকে পেয়েছিলেন মুস্তাফিজ। কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। গুলিস্তানের টার্মিনালে যখন নামলেন তিনি, পুরো এলাকা ফাঁকা। শংকরের বাস ধরার জন্য মুস্তাফিজ রাস্তার পার হয়ে এলেন। বাস আসছে না। আরও কিছু যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে। বড় রাস্তা থেকে কিছু দূরে একটা ঘুপচি রেস্টুরেন্টের মুখে ভিড়। রেডিওতে কেউ বক্তৃতা দিচ্ছে। মুস্তাফিজের মনে হলো, সামনে গিয়ে শুনলে হয়। দুপুর থেকে রেডিও শোনা হয়নি। তিনি রেস্টুরেন্টের কাছে যাওয়া মাত্র শুনলেন অচেনা কণ্ঠ বলছে, ‘হায়েনার কবল থেকে দেশকে মুক্ত রাখার জন্য আমি দেশপ্রেমিক মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছি। আধিপত্যবাধের থাবা থেকে এক দেশকে মুক্ত করা হয়েছে।’ মুস্তাফিজের মনে হলো, কুলাঙ্গার বেইমানটা এখনি হেসে উঠবে। যেভাবে হায়েনারা হাসে। ঐ বিষাক্ত রক্ত-হিম-করা হাসি তিনি শুনতে চান না। তাঁর মাথাটা কেমন জানি ঘুরে উঠল। ভিড় ঠেলে তিনি এগিয়ে গেলেন ট্রানজিস্টারটার কাছে। তারপর বিদ্যুৎবেগে ওটা মাথার ওপর তুলে নিয়ে মাটিতে আছড়ে ফেললেন। তিন-চার টুকরো হয়ে রেডিওটা ছিটকে পড়েছে।
টলছিলেন মুস্তাফিজ। জীবনে তিনি মদ স্পর্শ করেননি। ভালো করে দেখেনওনি বস্তুটি। কিন্তু এমন মনে হচ্ছে, তিনি পুরো মাতাল। মোহাম্মদপুরের বাস এসে গেছে। তিনি দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠে বসলেন। পেছন থেকে কে একজন চিৎকার করে উঠল, জব্বর দেখাইলেন মাতোয়াল ভাই। কয় বোতল খাইছেন?
রেস্টুরেন্টের মালিক লোকটা তেড়ে ছুটে আসতে আসতে বাস ছেড়ে দিল। শহরের সব স্ট্রিটলাইট আজ জ্বলেনি। অনেক নিয়ন সাইন নেভানো। এক ভুতুড়ে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে প্রায় ফাঁকা বাসটা ছুটে চলে।
0 comments:
Post a Comment