Tuesday, July 28, 2020

জাদুকরের মৃত্যু , গল্প ( হুমায়ুন আজাদ)



জাদুকরের মৃত্যু
হুমায়ুন আজাদ

আমাদের একমুঠো দেশটির মানচিত্রের দিকে তাকালে সেটিকে দোমড়ানো বুটের মতো মনে হয়। আগে এমনমনে হতো না; যে-দিন বর্বররা এল, দখল করল আমাদের দেশটি, সে-দিন থেকেই এমন মনে হতে থাকে। আমাদের ছোটো, চোখে-না-পড়ার মতো দেশটি যে পুরাণের কোনো সুখলোক ছিল, বা ছিল কোনো স্বর্গের টুকরো, তা নয়; তবে তাকে দোজখ বা নরকের সাথে তুলনা করাও ঠিক হতো না। দেশের প্রসঙ্গে অবশ্য একটু বাড়িয়ে বলার অভ্যাস ছিল আমাদের; বিশেষ করে দামি, দুষ্প্রাপ্য ধাতুর সাথে দেশের মাটির তুলনা করা আমাদের দারিদ্র কৃষক থেকে গরিব কবিদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এক আমরা গণ্য করতাম প্রেমিক বা পুত্রের স্বতঃস্ফূর্ত অতিশয়োক্তি বলে। একটুও লজ্জা বা বিব্রত বোধ না করে গ্রহের সবচেয়ে রূপসী দেশ বলে স্তব করতাম আমাদের দেশের, যদিও অনেকের খুবই ভালোবাসে জানা ছিল যে, এ-গ্রহে আমাদের দেশের থেকে রূপসী দেশ অনেক রয়েছে। আমাদের চাষিরা যদিও গান গাওয়ার অবসর খুব কমই পেত, মাঠে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হতো তাদের, তবুও আমরা ভাবতাম যে গানে তাদের গলা পরিপূর্ণ। এক হাজার বছর ধরে যদিও আমাদের দেশে একরকম অস্পষ্ট আকাল লেগেই ছিল, বেশির ভাগ মানুষের মাস ও বছর যদিও কাটত অনাহারে আধআহারে, তবুও আমরা ভালোবাসতাম গোলাভরা ধানের উপকথা বলতে ও শুনতে। আমরা ভালো ছিলাম না, তবু বেশ ভালো ছিলাম, আমরা বেশ খারাপ ছিলাম, তবুও খারাপ ছিলাম না। একদিন বর্বররা এল। সে-দিন থেকে আমরা ভালোই ছিলাম, তবু ভালো ছিলাম না, সে-দিন থেকে আমরা খারাপ ছিলাম না, তবুও খারাপ ছিলাম। বর্বররা আসার পর আমরা পুরোপুরি বদলে গেলাম। প্রথমে দেশকে, যে-দেশকে আমরা গড়ে তুলেছিলাম নানান রঙের অতিশয়োক্তিতে, সে-দেশ আমাদের চোখে দেখাতে লাগল মরা দোয়েলের মতো কদাকার। দেশের স্তব করার যে-অভ্যাস আমাদের ঐতিহাসিক স্বভাবে পরিণত হয়েছিল, তার থেকে আমরা হঠাৎ মুক্তি পেয়ে গেলাম। বর্বররা আসার পর থেকে সোনার সাথে দেশের মাটির তুলনা আর কেউ করেনি; তাকে খুব রূপসী বলেও দাবি করেনি কেউ। লজ্জায় যে আমরা অমন তুলনা থেকে বিরত হয়েছিলাম, তা নয়; অমন তুলনার কথা মনেই হয়নি কারও। অসুখ হলে মানুষের যেমন বদল ঘটে, যেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায় মুখ, বা মানুষের মরণের দিকে এগোতে থাকলে যেমন বিবর্ণ হয়ে ওঠে চোখের তারা, তেমন বদলের ছোঁয়া লাগে আমাদের সবকিছুতে। সবুজ রংটি আমরা পছন্দ করতাম। আমাদের গাছপালায় ওই রংটি বেশ ভেজা ভেজা রকমের ছিল, ছুঁলেই আঙুলে রং লেগে যাবে বলে মনে হতো; সেই ভেজা সবুজ রং, বর্বররা আসার পর, কালচে হয়ে উঠতে থাকে। বহু পুকুর ছিল আমাদের দেশে। পুকুরে পানি, আর ওই পানিতে পাবদা, ট্যাংরা, নলা, বোয়াল, কাতল, চিতল, রুই ও আরও অনেক ধরনের মাছের বসবাসকে আমরা সুনিশ্চিত প্রাকৃতিক ব্যাপার বলে মনে করতাম; কিন্তু ওই পানি, বর্বররা আসার পর, শুকিয়ে যেতে থাকে; এবং খুব পরিচিত মাছগুলোকে কীভাবে যেন মিশে যেতে থাকে পুকুরের শুকনো মাটিতে। আগে যেখানে-সেখানে ডুব দিয়ে শরীরটাকে ঠান্ডা করে নেওয়া যেত, চাষিরা ও দূরের পথিকেরা সাধারণত তাই করত; কিন্তু বর্বররা আসার পর আমাদের পুকুরের পানিতে আর গা ডোবে না, এমনকি খাওয়ার পানিও দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। নদী ছিল আমাদের দেশের আনন্দ ও দুঃখ দুই-ই। সে-নদীতে চর পড়তে লাগল। যে-নদী আগে কয়েক ক্রোশ চওড়া ছিল, বর্বররা আসার পর, চর পড়ে সে-নদী খালের মতো রোগা হয়ে উঠল। স্বাস্থ্যবতী নারী আমাদের বাসনাকে আলোড়িত করত, কিন্তু বর্বররা আসার পর আমাদের নারীরা কাঠের মতো শুষ্ক হয়ে উঠতে লাগল। স্বামী ও সন্তান ও প্রেমিক কাউকেউ পরিতৃপ্ত করার মতো সম্পদ তাদের রইল না।
আমাদের ঘরবাড়িগুলোকে যেন অসুখে ধরল। আগে ঘরের চাল, চালের ওপর খেজুরগাছের ডালপালা, জাংলায় লাউকুমড়োর ডগা, শিমের নীল ফুল, বাড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়া মেঠোপথ দেখলে বুক খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠত; কিন্তু বর্বররা আসার পর খুশি জিনিসটিই অচেনা হয়ে গেল। উঠোন গোবর দিয়ে দিনে দশবার লেপলেও আগের মতো ঝকঝক করত না, একবার ভিজলে শুকোতে চাইত না; ওই উঠোনে লাল লংকা, ধান বা অন্য কোনো শস্য শুকোতে দিলে বেলা পড়ে গেলেও তা শুকিয়ে আগের মতো ঝকমকে হয়ে উঠত না। আগে শীতে, গ্রীষ্মে, বর্ষায় নানান সবজি ও ফলে আমাদের উঠোন ও খেত ভরে উঠত। জাংলায় সবুজ লাউডগা ও ঝুলন্ত গোলাকার বা দিঘল লাউ আগে স্বাভাবিক দৃশ্য ছিল, যেমন ছিল ঘরের পাশেই ঝুলন্ত কুমড়ো, লাল হয়ে যাওয়া ডালিম, যুবতীর আঙুলের মতো ঢেঁড়স, পুঁইশাকের দৃশ্য। বর্বররা আসার পর এসব দুর্লভ হয়ে ওঠে। বন্ধুকে দেখে আগে ঝিলিক দিয়ে উঠত চোখ, স্নেহাস্পদ কাউকে দেখলে বুকে একরকম প্রীতির আলোড়ন অনুভব করতাম আমরা; কিন্তু আমাদের শরীর, বর্বররা আসার পর, এসব সংবেদনশীলতা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পায়। কারও মুখের রংই আর স্বাভাবিক ছিল না। রং চটে সকলেরই চোখেমুখে একটা বিমর্ষ ভাব এসে গিয়েছিল। ফুসফুস, মগজ, হৃদপিণ্ড চোখে দেখা যায় না বলে ওসবের অবস্থা কেমন হয়েছিল, জানি না, তবে আমাদের রক্তের রং যে বদলে গিয়েছিল, তা আমরা প্রায়-সবাই দেখেছি। খোঁচা লাগলে শরীর থেকে ময়লা রঙ বেরোত, এত ময়লা যে আগে হলে খুবই ঘেন্না লাগত; কিন্তু বর্বররা আসার পর ঘেন্নাবোধও আমাদের নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলে ওই রক্ত দেখে কারও বমি পেত না। অনেকদিন আমরা কোনো স্বপ্ন দেখিনি। আগে দিবাস্বপ্ন দেখেই আমাদের দিনের অর্ধেক কাটত, কিন্তু বর্বররা আসার পর ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখাও আমাদের স্থগিত হয়ে যায়। আমাদের চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় এমন শূন্য চোখে কোনো স্বপ্ন জন্ম নিতে পারে না; আর দিবাস্বপ্ন দেখার জন্যে দরকার যে-কল্পনাশক্তি, প্রয়োজন যে-কামনা, তা আমাদের বুক থেকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। যুবকেরা স্বপ্ন দেখত না, বুড়োরাও মনে করতে পারত না কোনো স্বপ্নের স্মৃতি। নারীদের আমরা অনেকদিন আদর করি না; শিশুদের আমরা অনেকদিন বুকে জড়িয়ে ধরিনি। বর্বররা আসার পর কয়েক মুহূর্তের অধিককাল নারীসংসর্গ সহ্য করাও অসম্ভব হয়ে ওঠে আমাদের পক্ষে; এবং শিশুদের গালে চিবুক ছোঁয়াতেও আমরা পীড়িত বোধ করতে থাকি। শস্যক্ষেত্রে, বর্বররা আসার পর, মারাত্মক রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। পাকা ধান কাটতে গিয়ে চাষিরা দেখে শস্যকণায় পচন ধরেছে। অনেক ধানের দুধ শক্ত না হয়ে ঘোলা হলদে হয়ে গেছে। সরষে, তিল, কাউনের মতো ফসল দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে; কোনো খেতেই এসব শস্যের বীজ ফেললে অঙ্কুরিত হয় না। চারপাশে দেখা যায় আগাছর পুলকিত উদ্গম। আগে এসব আগাছা ছিল না। কিছু আগাছা এক পশলা বৃষ্টিতেই উদ্গত হতে থাকে, এবং দিন সাতেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সারা এলাকায়। কিছু আগাছা জন্ম নেয় অনাবৃষ্টিতে; দিন কয়েক রোদ হলেই অসংখ্য কাঁটা নিয়ে মাটির নিচ থেকে রাক্ষসের মতো মাথা তোলে একধরনের আগাছা, যার আক্রোশে ফসল তো বাঁচাতেই পারে না, এমনকি চাষিদের হাত-পা-শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে ক্ষেতে দ্রুত পুঁজের আবির্ভাব ঘটে।
বর্বররা আসার পর কিছু কথা পুনরাবৃত্ত হতে থাকে আমাদের দেশ জুড়ে। বাইরের কেউ শুনলে মনে করতে পারত যে আমরা কারও কাছে এসব শুনে শিশুর মতো মুখস্থ করেছি, আর পথেঘাটে, বাজারে, চায়ের দোকানে যখন একে অপরের মুখোমুখি হই তখন মুখস্থ কথাগুলোই বারবার বলি। মনে করতে পারত যে আমাদের ভাষার শব্দভাণ্ডার খুবই দরিদ্র, আর বাক্যও মুষ্টিমেয়। আসলে এসব কথা আমরা মুখস্থ করিনি, একে অপরের সাথে দেখা হলে ভেতর থেকে ওই কথাগুলোই বেরিয়ে আসত, নতুন কিছু বলার উৎসাহও জাগত না। কেউ হয়তো বলত, ‘নদীতে চর পড়েছে’, এর উত্তরে শ্রোতা হয়তো বলত, ‘মাঠে আজকাল বাঁশি বাজে না’। ‘নদীতে চর পড়েছে’র উত্তর যে ‘মাঠে আজকাল বাঁশি বাজে না’ হয় না, তাও আমরা বুঝে উঠতে পারতাম না, যদিও একসময়, বর্বররা আসার আগে, তা আমরা ভালোভাবেই বুঝতাম। কেউ হয়তো বলত, ‘অনেকদিন স্বপ্ন দেখিনি’, এর উত্তরে শ্রোতা হয়তো বলত, ‘মেয়েদের বুক শুকিয়ে যাচ্ছে’। তরুণেরা অবশ্য ‘স্বপ্ন কাকে বলে’  ধরনের কথা বলতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল, কেননা তারা কখনো স্বপ্ন দেখিনি। বয়স্করা, যারা অনেক আগে স্বপ্ন দেখেছিল, স্বপ্ন দেখার অভিজ্ঞতা আছে বলে যারা গৌরব বোধ করত, তারাও স্বপ্ন ব্যাপারটি বোঝাতে গিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ত। ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারত না স্বপ্ন জিনিসটি কী, এমনকি তারা ঠিকমতো মনেও করতে পারত না তাদের অনেকদিন আগে দেখা স্বপ্ন। ‘অনেকদিন মেলায় যাইনি’ হয়তো কেউ বলত; উত্তরে শ্রোতা হয়তো বলত, ‘বৃষ্টির কি কোনো সম্ভাবনা আছে?’ এমন সব কথা, বর্বররা আসার পর, শোনা যেত আমাদের দেশে। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম স্বপ্ন দেখতে; নষ্ট হয়েছিল আমাদের সব স্বপ্ন। আশা বলে একটা জিনিস আগে ছিল আমাদের, বর্বররা আসার পর তা পুরোপুরি লোপ পায়। নতুন জামা পরলে যে-আনন্দ লাগে, তা থেকে আমরা বঞ্চিত হই; এমনকি আমাদের শিশুরাও নতুন জামা পরে উল্লাস বোধ করে না। বর্বররা আসার পর কখনো মনে হয়নি হে যুবতীদের গ্রীবার বা সম্মুখভাগের দিকে একবার তাকাই; কখনো মনে হয়নি যে একটু রাত বেশি জেগে থেকে একা একা গান গাই, পুরনো সুর মনে করে বুকটাকে ভিজিয়ে তুলি, বা নতুন সুর গুনগুন করে বুকের কামড় খাই। বর্বররা আসার পর কখনো মনে হয়নি যে একবার পান করে মত্ত হই, বা গভীর কিছু ভেবে ধ্যানস্থ হই, ইচ্ছে হয়নি যে একটু পাপ করি বা সাধ হয়নি যে একটু পুণ্য জমাই অন্য কোনো কালের জন্যে; মনে হয়নি যে-পথে হাঁটিনি সে-পথে একবার হেঁটে আসি, বা যেখানে কোনো পথ নেই সেখানে একটা নতুন রাস্তা বানাই। বর্বররা আসার পর আমরা মরেও যাইনি, বেঁচেও থাকিনি; বর্বররা আসার পর আমরা বেঁচেও থাকিনি, আবার মরেও যাইনি।
এমন সময় এমন অবস্থায় সেই জাদুকর আসে। কোথা থেকে এসেছিল আমরা জানি না। তার জাদু আমাদের এত মুগ্ধ করেছিল যা আমরা সবাই বলাবলি করতাম জাদুকর এসেছে আকাশের নীল দরজা খুলে, কারও মতে মাটির নিচে একটা সোনার জগৎ আছে সেখান থেকে, কারও মতে সমুদ্রের ভেতর থেকে এসেছিল। আমরা, বর্বররা আসার পর, মুগ্ধ হওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম, হারিয়ে ফেলেছিলাম রহস্য দ্বারা আলোড়িত হওয়ার ক্ষমতা। জাদুকর আমাদের ফিরিয়ে দেয় সেই শক্তিÑমুগ্ধ হওয়ার রহস্য অনুভব অলৌকিক শক্তি। জোয়ারের সাথেই তার তুলনা করা চলে। একটা জোয়ার আসে আমাদের বিমর্ষ জীবনে। জাদুকরকে আমরা কেউ কাছে থেকে দেখিনি, তাই তার মুখটি দেখতে কেমন ছিল, বা চোখের রং কী ছিল, বা চুলে তার কী রকম ঢেউ খেলত, তার আমরা কেউ ঠিক মতো বলতে পারব না। সে কাছে এলেও তাকে মনে হতো খুব দূরে, আবার দূরে থাকলেও মনে হতো বুকের কাছে। সে যখন হাসত মনে হতো তার হাসিটি একেবারে আমার মুখের ওপর বা আমি নিজেই যেন জাদুকর হয়ে হাসছি, পরমুহূর্তেই মনে হতো আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে সে, তার হাসিটি ভাসছে চাঁদের একপাশে বা মেঘের ভেতর। জাদুকর আমাদের কাছে ছিল শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রজালের মতো। তার মুখের দিকে তাকালে আমরা তার মুখে বর্বররা আসার আগে আমাদের পুকুরের টলটলে পানি, ঢেউ, মাছের ঘাঁই দেখতে পেতাম; দেখতাম তার মুকুটে ঝকঝক করে উঠেছে আমাদের অনেক আগের দিনেই উঠোন, নদী বয়ে চলেছে শাঁইশাঁই করে, একঝাঁক ইলিশ ঢেউয়ের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে উজানে। তাকে দেখাই আমাদের চোখে ছিল জাদু দেখা। তার হাতের লাঠির দিকে তাকিয়ে বুড়োরা বলত যে স্বপ্ন অনেকটা ওই লাঠির রহস্যময় আন্দোলনের মতো ছিল। সেই জাদুকর আমাদের গরিব পাড়াগাঁয়ে, বিষণ্ন শহরে, উশকোখুশকো মাঠে, বিবর্ণ বনে বনে জাদু দেখাতে লাগল। সাড়া পড়ে গেল দেশ জুড়ে। তার জাদুতে ঝিলিক দিয়ে উঠত রহস্য ও বিস্ময়, শোভা ও স্বপ্ন ও আরও অনেক কিছু; আর আমরা ব্যাকুল বালকের মতো দাঁড়িয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখতাম তার জাদু। সে এ-মুহূর্তে হয়তো জাদু দেখাত এক শহরে, পর মুহূর্তেই জাদু দেখাত অন্য কোনো শহরে, অনেক সময় সে একই জাদু দেখাত নানা শহরে ও গ্রামে।
জাদুকরেরা সাধারণত কোনো তাঁবুতে বা প্রেক্ষাগারে পরিকল্পিত পরিবেশের মধ্যে জাদু দেখিয়ে থাকে, কিন্তু সেই জাদুকর তাঁবুতে বা প্রেক্ষাগারে জাদু দেখাত না। কখনো, সে জাদু দেখাতে শুরু করত চৌরাস্তায়, একে একে মানুষ জমত, একসময় রাস্তা উপচে পড়ত অভিভূত অসংখ্য মানুষে। মনে হতো রাস্তাঘাট, চারপাশের ঘরবাড়ি, যানবাহন অভিভূত হয়ে পড়েছে জাদুতে, তারা চলে গেছে কোন স্বপ্নপুরীতে, যেখান থেকে তারা কোনো হারানো ধন মুখে করে উঠে আসবে বাস্তবে। কখনো সে গ্রামের মেঠোপথে শুরু করত খেলা দেখাতে। মাঠের কোনো রাখালের চোখে হয়তো প্রথম পড়ত সে, রাখাল জাদু দেখার জন্যে এগিয়ে আসত তার দিকে, তারপর ধান, তরমুজ, সরষে, সবজিখেত থেকে আসত চাষিরা। তারা দেখত জাদুকরের লাঠির ছোঁয়ায় আকাশ থেকে নেমে আসছে বিশাল তরমুজ, ওই দিকে পেকে উঠেছে আমন ধান, নদী বয়ে চলেছে গর্জন করে, নৌকা ছুটে চলেছে, জাংলায় জুলছে লাউ, মাটির ওপর থেকে উঠছে মিষ্টিকুমড়ো। তার জাদুতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ত চারপাশ; চাষিরা, চাষিবউরা, মাঠের পশুরা। কিছুক্ষণ পরে যখন জাদুর রেশ কেটে যেত তাদের চোখেমুখে লেগে থাকত এক আশ্চর্য অতীতের চুমোর দাগ, না-দেখা ভবিষ্যতের সোনালি রং।
বহুদিন পর, বর্বররা আসার পর, সেই প্রথম আবার জীবন ফিরে এসছে আমাদের জীবনে। জাদুকর যা সৃষ্টি করত তা সত্য ছিল না, কিন্তু আমাদের কাছে ছিল সত্যের থেকেও সত্য। জাদুকর গর্জনশীলনদী বইয়ে দিত আকাশে, সে-নদী সত্য ছিল না, তার লাঠির আন্দোলনে ফুটে ওঠা ফুল, ফলে ওঠা ফল সত্য ছিল না, কিন্তু আমাদের কাছে ছিল সত্য। আমরা ওই নদীতে ডুব দিতাম, ওই ফুলের গন্ধে আমাদের নাসিকা ও রক্তকণিকা ভরে উঠত, ওই সব ফলের স্বাদে আমাদের জিভ সুখী হতো। কিছুক্ষণের জন্যে আমরা হয়ে উঠতাম আমরা। জাদুকর আসার পর, তার রহস্যময় জাদু দেখার পর, অনেকেই আবার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। স্বপ্ন দেখার প্রথম ভাগ্য হয়েছিল এক চাষির। সে স্বপ্ন দেখে যে তার রোগা গাভিটি একটি স্বাস্থ্যবান এঁড়ে বাছুর প্রসব করেছে, আর তার আঙুলের ছোঁয়ায় গাভির বাঁট থেকে চারটি শুভ্র শিখার মতো নেমে আসছে দুধের ধারা। স্বপ্ন দেখেই সে উল্লসিত হয়ে ওঠে; পাশের শোয়া অসুস্থ স্ত্রীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে স্বপ্নের কথা বলে। স্ত্রী প্রথমে বুঝতেই পারে না তার স্বামী কি বলছে, তবে কিছুক্ষণ পরে ব্যাপারটি তারও পুরোপুরি অবোধ্য থাকে না। স্ত্রী তার স্বামীকে জানায় যে-গাভির কথা তার স্বামী বলছে, সেটি অনেক আগেই মারা গেছে। এতে স্বামিটি দুঃখিত না হয়ে খুশি হয়ে ওঠে; কেননা যে-গাভি তার একদিন ছিল, যা এখন আর নেই, সে-গাভিটিকে দেখতে পেয়েছে। যে-গাভিটি তার বুক জুড়ে ছিল কিন্তু কোথাও ছিল না, যাকে দেখার জন্যে তার রক্তে পিপাসা ছিল, তাকে সে দেখতে পেয়েছে। স্বপ্নের ঘটনাটি পরের সকালেই আগুনের শিখার মতো দিকে দিক ছড়িয়ে পড়ে। দিকে দিকে লোকজন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। পথের পাশে ভাঙা কুঁড়েঘরে ঘুমিয়ে ছিল এক ভিখিরি, সে দেখতে পায় এক আশ্চর্য স্বপ্ন। বস্তিতে ছেঁড়া চটের ওপর শুয়ে ছিল এক ক্লান্ত শ্রমিক, সে এক স্বপ্ন দেখে লাফিয়ে ওঠে। শহরের মধ্যবিত্ত বাড়িতে এক যুবক সারা রাত ঘুমোতে না পেরে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে; কিছু পরেই একটা রুই মাছ স্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। এক বুড়ো অনেকদিন ঘুমোতে পারছিল না, সন্ধ্যায় জাদুকরের জাদু দেখে ঘুমিয়ে পড়ে; মাঝরাতে সে স্বপ্ন দেখে যে বনের মধ্যে কাঁদছে একটি হরিণ। এক কিশোরী স্বপ্ন দেখে যে আকাশে নীল চাঁদ উঠেছে। এক যুবতী স্বপ্ন দেখে যে সোনারঙের একটি ঘোড়া বিছানায় তার পাশে ঘুমিয়ে আছে। দিকে দিকে ঘটতে থাকে বিচিত্র স্বপ্নের ঘটনা; আর স্বপ্নই হয়ে ওঠে আমাদের বাস্তব। বর্বররা আসার পর থেকে আমরা কোনো স্বপ্ন দেখিনি, অজানালোক থেকে জাদুকর আসর পর আবার স্বপ্ন দেখতে থাকি।
জাদুকরের কিছু জাদু আমাদের কাছে লাগত মধুর, তাতে আমরা বাঁশির সুর শুনতাম। পচনলাগা ধানখেতের আলে দাঁড়িয়ে সে দেখাত তার আঙুলে গজিয়ে উঠছে ধানের ছড়া; তাতে ঝিকমিক করছে পাকা ধান। আমরা দৌড়ে গিয়ে তার হাত থেকে ছড়াগুলো নিয়ে ধান খুঁটে বের করতাম পুষ্ট শাঁস। কোনো শাঁসেই পচন লাগেনি। একের পর এক, অনবরত, ধানের ছড়া গজাত তার দু-হাতের আঙুলে। বিচিত্র ধরনের ধান সব; সব ধানের নামও আমাদের জানা ছিল না। জাদুকর আমাদের জানাত অনেক আগে ওই সব ধান ফলত আমাদের জমিতে; যে-ধানগুচ্ছ থেকে সুবাস বেরিয়ে আসছে, তার প্রচুর ফলন হতো পাশের খেতে; আর মুক্তোর মতো যে-ধানগুলো, তার রূপে একসময় ঝলমল করে উঠত বিলের পর বিল। একটি শুকনো আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে জাদুকর; আমরা অপেক্ষায় আছি; আর অমনি গাছটির দিকে তাকিয়ে দেখি লাল লাল পাতা গজিয়ে উঠছে গাছে, সবুজ হয়ে উঠছে পাতাগুলো, বাতাসে কাঁপছে। বোল ধরছে ডালে ডালে, আমাদের চোখ ভরে যাচ্ছে হলদে বোলের রঙে। জাদুকর চলে যাওয়ার পর গাছটি আবার পরিণত হতো শুকনো গাছে; কিন্তু আমরা ওই গাছের দিকে তাকিয়ে বিভোর হয়ে থাকতাম। দীর্ঘশ্বাসে বুক ফুলে উঠত।
তখন আমাদের ছোট দেশটিতে বর্বররা আসার পর যেখানে কোনো স্বপ্ন ছিল না, সেখানে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছে, যেখানে কোনো গান ছিল না, গান গাওয়া শুরু হয়েছে সেখানে, যেখানে কোনো স্মৃতি ছিল না, সেখানে স্মৃতি জেগে উঠতে শুরু করেছে। জাদুকরের মধুর জাদু তখন আমাদের আলোড়িত করছে, জাগিয়ে তুলছে। জাদুকর একদিন আমাদের দেখাল এমন ভয়ানক জাদু, যা আমরা আশা করিনি। চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, মুখে তার অন্য রকম রহস্য। ভিড় জমতে শুরু করেছে। নতুন কোনো রহস্য দেখার জন্যে অন্য রকম হয়ে উঠেছে সকলের চোখমুখ। কিন্তু অল্প পরেই এক ভয়ংকর জাদু দেখে আমরা সবাই আর্তনাদ করে উঠলাম। জাদুকর তার দু-হাত উঁচিয়ে দেখাল তার হাত বনের পাখির মতোই মুক্ত; কিন্তু পরমুহূর্তেই সবাই দেখলাম তার হাত দুটি শৃঙ্খলিত। শৃঙ্খলিত হাত দেখে বুক থেকে আমাদের অজ্ঞাতে আর্তনাদ বেরিয়ে এল। জাদুকরের ওই হাতে, বিদ্যুৎশিখার মতো ওই হাতে, কেউ শেকল দেখার কথা ভাবতেও পারেনি। তার এতদিনের জাদুগুলোর মধ্যে এটাই যেন সবচেয়ে অভাবিত। জাদুকর লাফিয়ে তার মুক্ত পা দুটি দেখাল। একটু পরেই সবাই দেখলাম তার পা দুটিও শৃঙ্খলিত। শৃঙ্খলিত জাদুকর চৌরাস্তায় লুটিয়ে পড়ল। সবাই চিৎকার করে জাদুকরের দিকে ছুটতে যাচ্ছিল; কিন্তু সবাই দেখল তাদের পা শৃঙ্খলিত; ওপরের দিকে হাত তুলে চিৎকার করতে গিয়ে সবাই দেখল তাদের সকলের হাতই শৃঙ্খলিত। শরীর শৃঙ্খলিত। শৃঙ্খলিত অবস্থায় চৌরাস্তায়, উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম থেকে আসা রাস্তায় তারা পড়ে রইল। তখন যারা ওখানে ছিল না, তারাও হঠাৎ রূঢ় আঘাতে চমকে উঠল। মাঠে চাষ করছিল চাষি, হঠাৎ তাদের হাত থেকে লাঙল খসে পড়ল; তারা দেখল তাদের হাতে শেকল, এগোতে গিয়ে দেখল পায়ে শেকল। মাঝি নৌকো বেয়ে চলছিল নদী দিয়ে, হঠাৎ হাত থেকে বৈঠা খসে পড়ল; তারা দেখল তাদের হাতে শেকল, পায়ে শেকল। মজুরেরা কাজ করছিল ইটখোলায়; তাদের মাথা থেকে ইটের বোঝা পড়ে গেল, তারা দেখল তাদের হাতে শেকল, পায়ে শেকল। শ্রমিকেরা দেখল তাদের হাতে শেকল। পায়ে শেকল। শিশুরা পাঠশালায় আ-তে আম বলে পাঠ মুখস্থ করছিল, তারা হঠাৎ দেখল তাদের হতে পায়ে অজগরের মতো শেকল উঠেছে। শেকরের ভারে তারা বেঞ্চ থেকে লুটিয়ে পড়ল। সব ধরনের বিদ্যালয়ে বিদ্যার্থীরা দেখল তাদের হাতে শৃঙ্খল, পায়ে শৃঙ্খল। বিভিন্ন কর্মস্থলে কাজ করছিল যারা, তারা হঠাৎ দেখল কলম খসে পড়েছে হাত থেকে; আর ওই হাতে শেকল, পা নাড়তে গিয়ে দেখল পায়ে শৃঙ্খল। আকাশে উড়ে যাচ্ছিল বক, বালিহাঁস; ডালে বসেছিল দোয়েল, ময়না; হঠাৎ পাখিদের ডানা জড়িয়ে পড়ল শেকলে, আর তারা উড়াল থেকে, ডালে বসা থেকে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। একটি কোকিল গান ধরেছিল; তার গলায় শেকল এত শক্ত হয়ে জড়াল যে গানের বদলে তার গলা থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। আমরা আমাদের ছোট দেশের ছোট আকাশে একটা বড় শৃঙ্খল ঝুলতে দেখলাম। দেখলাম আকাশে মেঘেরা শৃঙ্খলিত, কিছুক্ষণের জন্যে সূর্যের আলো কমে এল, দেখলাম আমাদের সূর্যকে ঘিরে একটা শৃঙ্খল।
ওই শৃঙ্খরিত অবস্থা বেশিক্ষণ ছিল না; কয়েক মুহূর্তে জাদুকর বিদ্যুতের মতো হাত-পা নাড়ল; তার শৃঙ্খল হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। জাদুকর নতুন ধরনের রহস্যময় হাসি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। চৌরাস্তায়, নানান রাস্তায়, দেশ জুড়ে চাষি, মাঝি, মজুর, শ্রমিক, বিদ্যার্থী, নারী, পুরুষ, পাখি ও প্রাণীর হাত-পা-শরীর থেকেও খসে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল শৃঙ্খল। যে যার পথে চলে গেল, কিন্তু সকলের হাতে পায়ে লেগে রইল অদৃশ্য শেকলের দাগ; যে যার কাজে নিবিষ্ট হলো, কিন্তু সকলের হাতে-পায়ে ঝুলে রইল একটা অদৃশ্য শেকলের ভার। এরপর আমরা সবাই হাতে-পায়ে-শরীরে একটা ভার বইতে লাগলাম। একটু অন্যমনস্ক হলেই মনে হতো শেকলটা যেন শক্ত হয়ে উঠছে, হাত-পা নাড়তে কষ্ট হচ্ছে। শব্দও শুনতে পেতাম শেকলের।
কিছুদিনের জন্যে জাদুকর অদৃশ্য হয়ে গেল; তাকে কোথাও দেখতে পাই না। কিন্তু তার কথা মনে হলেই শেকলটাকে পাই। বাজারে যাচ্ছি, যেই একটু আনমনা হয়েছি, অমনি টের পাই হাতে শেকল; পা ফেলতে যাচ্ছি, কেমন অসুবিধা লাগছে, টের পাই পায়ে শেকল। চাষিরা চাষ করছে, মনে হচ্ছে পা আর চলছে না; তাকিয়ে দেখে পায়ে শেকল; ধান কাটছে, হাত চলছে না; তাকিয়ে দেখে হাতে শেকল। পরমুহূর্তেই নেই। বিদ্যার্থ ও অধ্যাপকেরা বিদ্যাচর্চায় রত, হঠাৎ দেখতে পায় হাতে-পায়ে শেকল। আবার নেই। জেলে, মাঝি, শ্রমিক কাজ করছে, টের পায় হাতে-পায়ে শেকল ঝুলছে। আবার নেই। শয্যায় নারীকে কাছে টানতে গিয়ে মনে হয় শেকলে বাঁধা পড়ে আছি; তাকে কাছে টানতে পারছি না। প্রেমিক নির্জনে প্রেকিমাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে দেখে হাত শৃঙ্খলিত; সে জড়িয়ে ধরতে পারছে না; চুমো খেতে গিয়ে টের পায় তার ওষ্ঠও শৃঙ্খলিত। সে-দিনের জাদুর পর মুহুর্মুহু আমরা হাতে-পায়ে একটা অদৃশ্য শেকল অনুভব করতে লাগলাম; বহন করতে লাগলাম একটা ভারী ভয়াবহ শেকলের ভার। একে অন্যের সাথে দেখা হলেই আমরা শুধু শেকলের কথা বলতাম।
আমরা যখন আমাদের অদৃশ্য শেকল নিয়ে ব্যস্ত, শৃঙ্খল যখন আমাদের একমাত্র চিন্তা হয়ে উঠেছে, তখন একদিন আবার চৌরাস্তায় দেখা গেল জাদুকরকে। তার চারদিকে জমতে লাগলাম আমরা। তারমুখে অন্য ধরনের হাসি, আর আমাদের চোখেমুখেও এমন এক অচেনা অভিব্যক্তি, যা আগে আমাদের, বর্বররা আসার পর, কখনো ছিল না। আমরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত বোধ করছিলাম, ভাবছিলাম আমাদের মুখে কী করে এল ওই অভিব্যক্তি, আর ওই অভিব্যক্তির তাৎপর্যই-বা কী? যা আমরা বুঝতে পারছিলাম না অথচ যা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল আমাদেরই অবয়স থেকে, তা হয়তো বুঝতে পারছিল জাদুকর। এমনও হতে পারে যে আমাদের চোখেমুখের ওই অভিব্যক্তিও ছিল অজানা থেকে আসা জাদুকরেরই জাদু। এবার সে যে-জাদু দেখাল, তা আরও অভাবিত ও উল্লাসজনক। জাদুকর আমাদের তার পায়ের দিকে তাকাতে বলল, আমরা দেখলাম তার বিদ্যুতের মতো পায়ে শৃঙ্খল; আমাদের সে তার হাতের দিকে তাকাতে বলল, আমরা দেখলাম তার বিদ্যুতের মতো হাতে শৃঙ্খল। তারপর জাদুকর আমাদের তাকাতে বলল নিজেদের হাতের দিকে; তাকিয়ে দেখি আমাদের হাতে শেকল, জাদুকর আমাদরে তাকাতে বলল নিজেদের পায়ের দিকে, তাকিয়ে দেখি আমাদের পায়ে শেকল। তারপর জাদুকর তার শৃঙ্খলিত বিদ্যুতের মতো হাত মাথার ওপর উঁচিয়ে যেই মোচড় দিল, অমনি ঝনঝন করে খানখান হয়ে গেল অজগরের মতো শৃঙ্খল। আমরাও তার সাথে সাথে মাথার ওপর আমাদের হাত তুলে মোচড় দিতেই টুকরোটুকরো হয়ে গেল আমাদের হাতের শেকল। জাদুকর লাথি দিতেই তার বিদ্যুতের মতো পায়ের শৃঙ্খল ঝনঝন করে খানখান হয়ে গেল। আমরাও তার সাথে সাথে লাথি ছুঁড়লাম, ঝনঝন করে টুকরোটুকরো হয়ে গেল আমাদের পায়ের শেকল। চৌরাস্তায়, পথে পথে, মাঠে মাঠে, বাজারে বাজারে, সব বিদ্যালয়ে, নদীতে নদীতে, ধানখেতে, কারখানায় বাজতে লাগল শৃঙ্খল চুরমার হওয়ার শব্দ। আমরা বারবার হাত উঁচিয়ে মোচড় দিতে লাগলাম, লাথি ছুড়তে লাগলাম, আর এক অভিনব বাদ্যঝংকারের মতো বাজতে লাগল শেকল চুরমার হওয়ার শব্দ। অমন মধুর, মহান, শিল্প রহস্যময় ধ্বনি আগে আমরা কখনো শুনিনি। আমাদের ছোট দেশটি ভরে সমুদ্রের গর্জনের মতো, বাদ্যসমবায়ের ঝংকারের মতো সেই শেকলভাঙার ধ্বনির ঢেউ উঠতে লাগল। আমাদের হাত-পা ভারহীন হয়ে উঠল। বর্বররা আসার পর এমন নির্ভার আমরা কখনো বোধ করিনি।
পরদিনই জাদুকরের লাশ পাওয়া গেল শহরের চৌরাস্তায়। বর্বরদের একটি বিশাল ছুরিকা আমূল গাঁথা জাদুরের হৃদপিণ্ডে।
আমরাও আবার ময়লা হয়ে উঠলাম, আমাদের ঘরবাড়িগুলো হয়ে উঠল রোগা শালিখের মতো, শস্যের কণায় আবার পচন ধরল। আমাদের ছোট দেশটিকে আবার মনে হতে লাগল মরা দোয়েলের মতো। স্বপ্ন দেখা ভুলে গেলাম আমরা। আমরা বেঁচে রইলাম, তবুও বেঁচে রইলাম না; আমরা মরে যাইনি, তবুও আমরা বেঁচে নেই। ঘরের দিকে ফিরতে আর আমাদের সুখ লাগে না, শিশুদের চিবুক ধরে আদর করতে আমাদের শখ লাগে না, নারীদের কাছে টানি না, তাদের বুকে মুখ রাখতে আমাদের সুখ লাগে না। আমরা আবার পুনরাবৃত্তি করতে লাগলাম একই কথা। কারও সাথে দেখা হলেই বলতে লাগলাম, ‘নদী শুকিয়ে যাচ্ছে’, ‘আকাশে বাঁশি বাজে না’, ‘বহু দিন মেলায় যাইন’, ‘পুকুরে কি আবার মাছ দেখা দেবে?’। ‘জাদুকরের কথা, খুবই গোপনে, বলত কেউ কেউ; তার কথা মনে হলে তার বুকে গেঁথে ছুরিকাটিকে মনে পড়ত আমাদের। কোথা থেকে এসেছিল সেই জাদুকর, যে আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল? স্বপ্নের মতো সত্য আর সত্যের মতো স্বপ্ন দেখানোর জন্যে সে আবার কবে আসবে?

0 comments:

Post a Comment