Monday, July 27, 2020

বঙ্গবন্ধুর এক অনন্য ভাষণ , প্রবন্ধ ( ড. অনুপম সেন)




বঙ্গবন্ধুর এক অনন্য ভাষণ
ড. অনুপম সেন

বাঙালি তার হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১ সালেই প্রথম একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এর আগে বাঙালি নিজের জাতিসত্তাকে কয়েক হাজার বছর ধরে রূপ দেয়। আজ যেখানে বাংলা-অঞ্চল সেখানে পুন্ড্রবর্ধন, সুক্ষ, রাঢ়, হরিকেল, বরেন্দ্র প্রভৃতি উপজাতি তাদের নাম অনুসারে বসতি স্থাপন করেছিল এবং এসব নামে বিভিন্ন অঞ্চল বা রাজ্যসত্তার অস্তিত্বের খবরও অস্পষ্টভাবে ইতিহাসে পাওয়া যায়। খুব স্পষ্টভাবে আমরা কর্ণসুবর্ণের স্বাধীন রাজা শশাঙ্কের কথা জানি; জানি, প্রায় চারশ বছর ধরে বাংলা, এমনকি বাংলাকে ছাড়িয়েও পাল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল। বাংলার এক অংশে সেন রাজারও ছিলেন প্রায় অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় জুড়ে। আরো জানি, সুলতানি আমলে স্বাধীন পাঠান-সুলতানরা বাংলা অঞ্চলকে প্রায় বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে পরিণত করেছিলেন। মোঘল সাম্রাজ্যের শেষভাগে মুর্শিদকুলি খাঁ, আলিবর্দি, সিরাজউদ্দৌলা প্রমুখ সুবেদার দিল্লির প্রতি নামমাত্র আনুগত্য স্বীকার করে প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলায় রাজত্ব করেছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে বাঙালির বাংলা কোনদিন রাষ্ট্রভাষা বা সরকারি ভাষার মর্যাদা পায়নি। রাজসভার ভাষা ছিল সংস্কৃত, পালি বা ফার্সি। সংস্কৃত বা ফার্সি ছিল প্রকৃতপক্ষে রাজন্যবর্গের বা বিদগ্ধজনের সর্বভারতীয় ভাষা। উপমহাদেশের এক প্রান্তের শিক্ষিত মানুষ অন্য প্রান্তের শিক্ষিত মানুষের সাথে অনায়াসে এই ভাষায় ভাবের আদান-প্রদান করতে পারতেন। তাই প্রকৃত অর্থে স্বাধীন বাংলা-রাজ্য মাঝে মাঝে সৃষ্টি হলেও স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র কোনদিন সৃষ্টি হয়নি ১৯৭১ সালের আগে, যেখানে প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষী বাঙালি নিজের জাতিসত্তার স্ফুরণ ঘটিয়ে নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানব অধিকারের স্বীকৃতি পেয়েছে নিজের রাষ্ট্রের সংবিধানে। স্বাধীন রাজ্যে রাজা বা রাজন্যবর্গ স্বাধীন হলেও প্রজারা ছিল পরাধীন, ব্যক্তি ছিল পরাধীন; এমনকি ব্যক্তির প্রাণও চলে যেত রাজন্যবর্গের মুহুর্তের হুকুমে, বিনাবিচারে। ব্যক্তির কূপমণ্ডূকতা আমাদের প্রায় গিলেই খেয়ে ফেলেছে। যে চর্চা করছি তাতে আদৌ বঙ্গসংস্কৃতির বিপুল ভাণ্ডারের বিন্দুমাত্র মানুষকে উপহার দিতে পারিনি। 

ফোক বলে ‘লোক-সংস্কৃতি’ যাকে বলছি, তা কেবলই ‘শিখে আসা’ জ্ঞানের মার্কটাইম বলতে পারি কিংবা বদ্ধ জলাশয়। বিকাশের ক্ষেত্রে আমরা পরোন্মুখ হয়ে নিজেদের ‘সমৃদ্ধ’ ভাবছি। এতে বাংলামায়ের নিজস্ব উত্তরাধিকারকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। নিজেদের অজান্তেই জানার ইচ্ছাও যে নেই সেটাও প্রকট হয়ে উঠেছে। সংস্কৃতি সংগঠনগুলো নিজ নিজ গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থেকে নিজেদের চর্চা ও পারঙ্গমতা নিয়ে গর্ব অনুভব করছে। কারণ এতেই তো ‘সস্তা জনপ্রিয়তা’ আর অর্থকারী লাভ কম হচ্ছে না। আবার আমাদের লোকসংস্কৃতি বিশাল ভাণ্ডারে যে অসামন্য মণি-মনিক্য রয়েছে তাকে ‘গেঁয়ো’ বলে সরিয়ে রেখে যা কিছু নিয়েছি পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে তাকে সত্যিকার বঙ্গসংস্কৃতি বলে উপস্থাপন করে তৃপ্তি লাভ করছি। সংস্কৃতির সুকুমার চরিত্রকে উপরি আবরণে ঢেকে ফেলে পরম পরিতোষে উপস্থাপিত সংস্কৃতিই ‘নিজস্ব’ বলে দর্শক-শ্রোতাকে ভাঁওতা দেয়া হচ্ছে। ফলে পূর্বপুরুষের সৃজনশীল সংস্কৃতি চর্চাকেও কোনো পাত্তা দিচ্ছি না, কেবলমাত্র এই ক্ষেত্রেই কেন বলি, রাজনীতি-যা সংস্কৃতিকে পরিপূর্ণ করে মানুষের অংশগ্রহণে, তাকেও কল্পনা আশ্রিত করে ফেলেছি আমরা। রাজনীতি যদি নষ্ট কিংবা আপসকামী হয় তবে তো কথাই নেই, একপেশে রাজনৈতিক চর্চা যদি দেশকে গ্রাস করে, বহুমতের স্বাধীনতা না থাকে তাতে, তবে সেই রাজনীতি যে গ্রহণযোগ্য হয় না মানুষের কাছে; তারতো উৎকৃষ্ট নমুনা পাকিস্তান জামানায় পেয়েছি। অথচ মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পুনরুদ্ধারকৃত মাতৃভূমিতেও কেন আমাদের সংস্কৃতি ‘খাবি’ খাচ্ছে ?
রাজনৈতিক চরিত্রগুলোর মধ্যে তো নির্মম দেশপ্রেমহীনতা লক্ষ করছি; দেখছি কেবল দুর্নীতিপরায়ণ লাভের লোভজাড়িত ভোগবিলাসী পরিস্থিতি সুজলা-সুফলা বাংলাদেশকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে। আমরা জনগণ নীরবে সহ্য করছি তাই। একথাতো ভুললে চলবে না, দেশমাতৃকার আসল পরিচয় ফুটে উঠে চর্চিত সংস্কৃতিতে। কিন্তু আজ প্রায় পঞ্চ দশকের পরে আমরা বলতে পারি কি যে তাই হচ্ছে? সোজা জবাব, না হচ্ছে না। কারণ রাজনীতিতে যে পক্ষ-বিপক্ষ থাকে, তাদের মধ্যেই গলদ ক্রমশ বিকশিত। এখন রাজনীতি কেবল ক্ষমতার দাপট, পক্ষ যা করছে বিপক্ষ তাকেই তীব্র ভাষায় কখনও বা নোংরামির মাধ্যমে সমালোচনা কিংবা বিরোধিতা করছে। এ দুয়ে তো সমতা নেই। ফলে দেশে বিরাজমান পরিস্থিতি ‘বেনোজল’-এর মতন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় সংস্কৃতির ভুমিকা কিন্তু অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষকে সংগঠিত ও জাগ্রত করা অনেক সহজ। কিন্তু সে রাজনীতির পরস্পরবিরোধী ‘গীবতচিত্র’ পঠিত হয়েছে, অথবা রাজনীতি হিংস্র-সহিংস্র বা আপসকামী হয়ে গেছে, সেখানে  দুর্নীতি এন্তার বাসা বেঁধেছে। ভোগবিলাসিতা ক্রমশ সীমাহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ক্ষমতাই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সুতরাং এই রাজনীতি মানুষের কল্যাণের চেয়ে ‘ভোটে  জেতার কৌশল’-এ পরিণত হয়েছে।  যে ক্ষেত্রে সংস্কৃতিকে তার অগ্রণী ভূমিকা পালন করে রাজনীিিতকে সঠিক নির্দেশনায় নিয়ে আসতে সহায়ক শক্তি হিসেবে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা তা করতে প্রধানত ব্যর্থ হচ্ছি। হয়ে পড়েছি দলীয় দর্শনের অনুরক্ত। তাই রাজনীতিকে আপন চরিত্র ফিরিয়ে আনার জন্য সংস্কৃতিকে আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌছাতে হবে। জনগণই সব শক্তির উৎস। এই কথাটি বলেন রাজনীতিবিদরা, কিন্তু স্বার্থের লোভে এ কথা ভুলেও যান। এই সম্মেলন আদর্শবান সংস্কৃতিকর্মী-সংগঠকদের একট্টা হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। তার কারণ ওই সমাজও মানুষের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং আরো ভয়াবহ কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছে মানুষের সামাজিক প্রাণ ও আত্মা। জুসে মতবাদ চলছে একটি তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক দেশে, আর সে আত্মাউন্নয়ন প্রকারন্তরে আরেক ভয়াবহ স্বৈরাচার, যার নিষ্পোষণে রুদ্ধ হয়েছে মানুষ। সেখানে লেখার স্বাধীনতা আসবে কোত্থেকে।
মনেই লেখালেখির মূল চালিকাশক্তি। হাত বা আঙুল নয়। মগজ মন নির্মাণের কারিগর, সে জ্ঞান প্রজ্ঞায় জারিত করে ভাবনা। তাকে ইতিহাস, বিজ্ঞান, নীতিবোধ, রাজনীতি, শিল্পসত্তা আর অভিজ্ঞতার ইন্ধন জোগায়। মন সামাজিক। সামাজিক বিধিনিষেধ কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনকে অবদমিত করে আবার ভাগারের দিকেও ধাবিত করতে পারে। যদিও কোনো কোনো কারণে পা সঞ্চালিত হয় এবং বিশ্বব্রক্ষাণ্ডের যাবতীয় কিছুর মুখোমুখী হয়। মন ফড়িংয়ের মতো ভেসে চলে, নানা কিছু অবলোকন করে, এর গতি এত দ্রুত যে পরিমাপের সুযোগ নেই। মন এগায় সে নানা অবয়ব তৈরি করে, ভাষাবন্ধনে সেসব নিজের মধ্যেই প্রকাশিত হয়। সে স্বর্গমর্তপাতাল পরিভ্রমণ করে, এবং কল্পনার পাখা মেলে নানা কিছুকে রূপান্তরিত করে। যে জায়গা আমরা কখনও দেখিনি কিন্তু অভিজ্ঞতা রয়েছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, মন সেখানে গমন করতে পারে এবং তার চাহিদামত দৃশ্যাবলির উপাদান, রসায়ন প্রস্তুত করে আনন্দ তৈরি করতে পারে। আমরা স্বর্গ দেখিনি তবু মন স্বর্গ নির্মাণ করে কোথায় কেমন ধাঁধার দরকার, সৌন্দর্য কেমন হওয়া উচিত তার চাতাল নির্মাণ করে ফেলি বা ফেলেছি। তাই যখন কোনো কিছু আমাদের মনে দারুণ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে এবং তুলনামূলকভাবে তার ভাষ্য আমরা আর ভাষায় রূপান্তর করতে পারি না তখন বলি স্বর্গীয়। কারণ মন চায় সুন্দর, মন সুন্দর কে ভালোবাসে, আর দৃশ্যমান সুন্দর ব্যক্তিকে এমনই উদ্দীপ্ত করে যে সে তার সীমিত শব্দে প্রকাশ-নির্মাণে সক্ষম হয় না। সে যে সুন্দরকে নির্মাণ করে ফেলে তা তার বোধের কিন্তু অভিজ্ঞতার মধ্যের যা সে চিনে নিতে পারে না নানা সামাজিক বন্ধনের কারণে। আর সৃজশীল মানুষ সেই রূপান্তরিত ভাষ্যই প্রকাশ করে যার যার নিজস্ব মাধ্যমে। সঙ্গত কারণে লেখার উদ্দীপনা মন থেকেই আগত। মনের পরিভ্রমণ থেকেই এর উৎপত্তি। কিন্তু কতক লেখকরা তাকে বলে স্বর্গীয় প্রেরণা। সেটা তার অসচেতনতার ফল। বাস্তবে সামাজিক বিশ্বাসের ভেতর থেকে তাদের এই আচরণ যা মূলত আত্মপ্রতারণা। এর মধ্যে রয়েছে সামাজিক ক্রিয়া। কেউ কেউ আজীবন ক্রীতদাসের ভূমিকায় অবতীর্ণ থাকে, টেরও পায় না। সামগ্রিক অসচেতনতাই এখানে মৌলকি। মন আর দেহের মধ্যে যে পার্থক্য তার স্থির দার্শনিক ব্যাখ্যা আজও মেলেনি। নানাভাবে এর ব্যাখ্যা হলেও প্রশ্নহীন নয়। তবে এ কথাতো সত্যই মন দেহ নির্ভর কলম ও কালির মতো। কলম তখনই তাতে কালি আছে, নয় যখন তাতে কালি নেই আর। জীবিত মানুষ তখনই যখন তার জীবন আছে, মৃত মানুষ মানুষ নয়, লাশ। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মনের পরিভ্রমণ শেষ। 
স্বর্গ আছে কী নেই সে প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন স্বর্গ কেমন এবং কী কী সুখভোগের আয়োজন সেখানে রয়েছে। কোনো একটা কিছুর কম হলেতো স্বর্গ মেনে নেয়াই কঠিন। বাস্তব জীবনে কোনো কিছু না থাকলে অতৃপ্তি আছে তবে বসবাসও আছে, সচেতন হলে নাগরিক পরিত্রাণ চায়, অসচেতন বলেই সে সমাজ নামক কারাভোগ করে। তাই কল্পনায় কোনো কিছুই অভাব রাখা হয়নি। বর্তমান বাস্তবতা যে তার চেয়ে সুখদায়ক এবং ভোগ যে অতলস্পর্শী তা সাধারণরা চিন্তা করতে পারে না। পৃথিবীর বিলাসবহুল হোটেলগুলো বা শাসকের প্রমোদ ভবনগুলো নমুনা হলেও ক’জনই বা তা দেখতে পেয়েছে। স্বর্গে ভাবিবা মাত্রেই যা কিছু পাওয়া যাবে সেখানে শর্ত আছে, এখানেও ভাবিবা মাত্র সবকিছু হাতের নাগালে আছে, এখানেও শর্ত বর্তমান অর্থাৎ তার উপযুক্ততা থাকতে হবে। এইসব চলমান কল্পনা মানব মনকে সর্বদাই আচ্ছন্ন করে রাখে, আর যারা খেতেই পায় না বা খেটে দুমুঠো জোগাড় করতে প্রাণান্ত তারাও আছন্ন থাকে এই ভেবে, একালে না হলেও ওকালে তো পাওয়া যাবে। এই মানসিকতা বয়ে চলেছে নদীর জলের মতো কখনো শংসয়ে উজানে কখনো বিশ্বাসে জোয়ারে। এসবের বদল খুব সহজ যে নয়, এবং রীতিমতো নিজেকে জানার লড়াইয়ে নিহিত, তা ভাববার সুযোগগুলোও সীমিত করে রাখা আছে চক্রান্তমূলক পদ্ধতিতে।  
সাহিত্য সমাজ ও ব্যক্তি-জীবনকে রূপানয় করে। সাহিত্যিক একজন ব্যাক্তি, ব্যক্তির ব্যক্তি হওয়ার মধ্যেই সাহিত্য। ব্যক্তির জীবনযাপন আচার প্রণালী দ্বারা সাহিত্যের মূল্যায়ন সঠিক নয় এই মতো অনেকের। তাই সাহিত্যালোচনা শুধুমাত্র সৃষ্টির উপরেই নিবদ্ধ রাখারই বঞ্ছনীয় এই মত চালু রয়েছে। সৃষ্টির ভেতরে কতটুকু নিঃশ্বাস-বায়ু আছে তাই নিয়ে আলোচনা চলতে পারে। কথাগুলোতে যুক্তি অনেক, নির্ভরতাও কম নয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় তা হলো ব্যক্তি নীতিকে ধারণ করে দায়িত্ববোধ থেকে। দায়িত্ববোধহীন মানুষ অন্য কোনো বিষয়ের দায়িত্ব নিতে পারেন কিনা। সাহিত্যের উদ্দেশ্য তাই কেবলই সৃষ্টি নয়, মহৎ কিছুর সন্ধান করা। এই মহৎ সাহিত্যকের নয়, সমাজের। যেমন আমরা তামাশা করে একটা ঘর তৈরি করলে তা ঘরই হতে পারে, তাতে বসবাসের উদ্দেশ্য সফল হয় না বা নদীতে বাঁধ দিলে পানি আটকে যেতে পারে কিন্তু পরিকল্পনামাফিক পানি প্রবাহ নিশ্চিত না করলে তা হয় ব্যক্তির স্বেচ্চাচারিতা, তেমনি সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য পরিকল্পিত না হলে এবং ব্যক্তির দেখা অনুভব বৃহতের দিকে না হলে তা কেবল বোবা সৃষ্টির মতোই হয়, বাঙময় হয়ে ওঠে না। আবার নৈতিকতায় বিশ্বাসীরাও তাদের সৃষ্টি জানবার শুনবার সুযোগ আমাদের দিয়ে গেছেন তা বিপুল মানুষের উদ্দীপনায় কাজে লাগছে, বিনোদন অর্থপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তাও আমরা পড়ছি, অনুভব করছি, আলোচনা করছি। 
সঙ্গত যে নৈতিকতা ব্যক্তির তা প্রতিফলিত হয় কাজে ও প্রকাশে। আর যেই নৈতিকতা প্যাটার্ন সমাজে রাষ্ট্রে বিদ্যমান বলে সৃজনশীল মানুষ খুব কমই তার বিস্তার থেকে দূরে   থাকতে পারে। এজন্য লেখকের আত্মশক্তির প্রবলতা থাকার প্রয়োজন এবং পরিশীলিত মনোভঙ্গি গ্রহণের ক্ষেত্রেও উদারতাবাদকে পরিহার করার জ্ঞান স্পষ্ট থাকার দরকার। বাস্তবে সৃষ্টি যে ধারার নৈতিকতার মান পায় তা লেখকের নৈতিকতার মানের সমান। লেখক যদিও আটকে আছে অনৈতিক সমাজিক নিয়মে তাই তার প্রকৃত মুক্তির লড়াইটা তার নিজের বিরুদ্ধেও দাঁড়ায় এবং কল্পিত ন্যায়কে বাস্তবে আনতে যে বিপুল জ্বালানি লাগবে সেই ক্ষেত্রটি পরিষ্কারভাবেই তৈরি করতে হয় লেখায়। কেবলমাত্র তখনই লেখকের নৈতিকতা এবং সাহিত্যের নৈতিকতা একই সরল রেখায় স্থাপিত হতে পারে। আবার দেখা যায় স্তবস্তুতিতে নিরলস লেখক বা শিল্পী আত্মবিক্রয়ে উন্মাদ প্রাপ্তির লোভে, যশ ও খ্যাতির লোভে সেটাও চলমান সামাজিক আঁটুনির। 
সাহিত্য শিল্প উদ্দেশ্যহীন নয়, তা যারা বলছেন তাদের সৃষ্টিও উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে বা হয়, পাঠককে বিভ্রান্ত করে, ন্যায় থেকে তার পরিচিত থেকে, ভাবনার দিগন্ত থেকে সরিয়ে দেয়, ব্যবসায়ীরা চুটিয়ে ব্যবসা করে পুুঁজির স্বার্থ রক্তিত হয়। আর যারা ন্যায় নিয়মে আত্মশক্তি নিয়োগ করে তারাও উদ্দেশ্যকে ছুঁয়ে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত সৃষ্টির ভোক্তা মানুষ, ততক্ষণ পর্যন্ত সব সৃষ্টিই গোপন-প্রকাশ্য  উদ্দেশ্যকে উদ্দেশ্য করে লেখা। বাইরে কিছু নেই। 

0 comments:

Post a Comment