Friday, July 31, 2020

মুক্তিযুদ্ধের গল্প বাদল , গল্প (সাইদ কামাল)


মুক্তিযুদ্ধের গল্প
বাদল
আবু সাইদ কামাল

শহরের কাচিঝুলি মোড়েই চারতলা ভবনে টেলিফোন রাজস্ব অফিস। জাহানারা এ অফিসেই সমবর্তী হিসাব নিরীক্ষা শাখায় কর্মরত। তখন দুপুর বারোটা। কাজের ফাঁকে কখনো চোখ বুলাচ্ছেন পত্রিকার পাতায়। পাশেই বসে আছেন সহকর্মী হাসিনা বেগম। 
এ সময়ে অফিস-কক্ষের দরজায় চৌকাঠে একজন আগন্তুক এসে পা রেখে বলে, এখানে ভালুকার জাহানারা নামে কেউ...?
-জি আমিই।
-আমি বাদল চক্রবর্তী।
-বা-দ-ল!
-হ্যাঁ-হ্যাঁ। ওই যে আপনাদের গ্রামের ঠাকুরবাড়ির...
-ও হ্যাঁ। বাদল তুমি? কতদিন পরে দেখা...। তা কী মনে করে? ঠিক আছে, আগে বসো। পরে কথা বলি।
-আচ্ছা বসছি।
বলেই বাদল টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে। তখন জাহানারা বলে, তারপর বলো, কী মনে করে...
-আগে তো ঢাকাই থাকতাম। মাস ছয়েক আগে এই শহরে আসলাম। টেলিফোন বিল নিয়ে একটু ঝামেলা। 
-চলো-এ ব্যপারে তোমাকে সহযোগিতা করতে পারবো বলে আশা করি।
এই বলে জাহানারা ম্যাডাম লোকটাকে নিয়ে একই অফিসের অন্য শাখায় ঢুকে। কিছুক্ষণের মাঝে লোকটার কাজের ব্যাপারে আশানুরূপ পদক্ষেপ নিয়ে শাখায় ফিরে আসে জাহানারা।
নিজের আসনে বসামাত্র হাসিনা বেগম বলে, কে এই ভদ্রলোক?
-আমাদের গ্রামের। একই ক্লাসে পড়ালেখা করতাম। বড়ই দুর্ভাগা লোকটা। 
-কী করেন তিনি?
-এখন অবশ্য ব্যাংক কর্মকর্তা। আপন বলতে তার জগতে আর কেউ নাই।
-ক্যান?
-এই ‘ক্যান’ শব্দটার জবাব দিতে মুক্তিযুদ্ধের একটি কাহিনী বলা লাগবে।
-মুক্তিযুদ্ধের গল্প? প্লিজ একটু বলুন না শুনি!
দ্বিধা করেও জাহানারা বেগম শেষ পর্যন্ত বলেন, আচ্ছা ঠিক আছে; বলছি। এই বলে তিনি গল্পটা শুরু করেন, তা হলো এই-
জাহানারাদের গ্রামের বাড়ি-ভালুকা উপজেলার বিরুনিয়া গ্রামে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ভালুকা থানার পাশে খিরু নদীর ওপর সেতুটার উত্তর পাশ থেকে মেদিলা-চুল্লার খাল হয়ে বিরুনিয়া যাওয়ার একটি রাস্তা আছে। বিরুনিয়ার বাজারের পশ্চিমেই গ্রামটির অবস্থান। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তো আর সড়ক যোগাযোগ ছিল না। কাওরাইদ রেলস্টেশন থেকে খিরু নদীপথে ভালুকা লঞ্চ চলাচল করতো। নৌকা বা জলযান ছাড়া যোগাযোগের মাধ্যম ছিল একমাত্র পায়ে হাঁটা। শুকনো মৌসুমে অবশ্য জলযান চলতো না। তখন গরুর গাড়ি আর পায়ে হাঁটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলনা।
জাহানারাদের পাশের বাড়িটার নাম ছিল ঠাকুরবাড়ি। বিরুনিয়া বাজার বেশ আগে থেকেই নানা কারণে বিখ্যাত। হিন্দু অধ্যুষিত বিরুনিয়া গ্রামটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ছিল অনন্য। বহুকাল ধরে বজায় ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। প্রতিবেশি ঠাকুরবাড়ির সাথে জাহানারাদের ছিল নিবিড়ি পারিবারিক সম্পর্ক। বাদল ছিল জাহানারার সহপাঠী। তার বড়ভাই দিলীপ তখন ছিল একই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। ক্লাসের মেধাবী ছেলে। ফার্স্ট বয়। তাকে ঘিরে মা-বাবা, পাড়া-প্রতিবেশি, স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক এবং এলাকাবাসীর কতো প্রত্যাশা ছিল! একাত্তরে পাক-হানাদার বাহিনী কাওরাইদ হয়ে জলযানে ভালুকা যাতায়াত করতো। ভালুকা থানায় ছিল পাকবাহিনীর ক্যাম্প। তখন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা আফসার মেজরের নেতৃত্বে বারবার মার খাচ্ছিল পাক হানাদাররা। মুক্তিযোদ্ধাদের আস্থানাও ছিল এই পাশ্চাদপদ কুল্লাব-বিরুনিয়া গ্রাম এলাকায়। এজন্যই ঐ এলাকাটি পাকবাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়। নদীপথে স্পিডবোডে এসে বারবার ওরা হানা দিতে থাকে খিরু নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে। চালাতে থাকে জ¦ালাও-পোড়াও এর মতো ধ্বংসযজ্ঞ। নির্বিচারে গুলি করে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায় একের পর এক। ওদের আক্রমণে প্রাণের ভয়ে দিশেহারা হয়ে নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে দিগি¦দিক ছুটতো শিশু-নারী-পুরষসহ সর্বস্তরের নিরস্ত্র মানুষ। 
এভাবে জাহানারাদের নিয়ে তাদের আব্বা-আম্মা কতবার যে নানাদিকে ছুটে গেছেন, তা আর বলে শেষ করা যাবে না। এক পর্যায়ে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, কেউ যদি গুজব ছড়িয়েও বলে যায়, ‘ঐ যে আইস্যা পড়ছে পাকবাহিনী আর রাজাকাররা’। অমনি দে ছোট। এমন গুজব ছড়িয়ে স্থানীয় দুবৃত্ত বা লুটেরারাও ততদিনে অনেকবার সুযোগ নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে হানাদার বাহিনীর আগমন বার্তা শুনেও বিষয়টি যাচাই না করে আর কেউ বাড়ি-ঘর ছাড়তো না। ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল সেদিন, যেদিন শিবগঞ্জ বাজারে যুদ্ধ শুরু হয়। টানা তিনদিন যুদ্ধ চলে, তখন এলাকায় কী থমথমে অবস্থা!
ঐ যুদ্ধের কয়েকদিন পরই তাদের গ্রামের ট্রাজেডিটা ঘটলো। তখন অনুমান সকাল দশটা বাজে। কারো কারো বাড়িতে সকালের নাস্তা পর্ব শেষ হয়েছে, কোনো বাড়িতে হয়তো বা নাস্তা খাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এমন সময় একজন কুলো, যে জাহানারাদের বাড়িতে সবসময় খাঁটি সরিষার তেল বিক্রি করতো, সে ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে তার আম্মাকে বলে, চাচি গো-ও চাচি! অহনও বাড়িত বইয়া রইছুইন। আইজ চারদিক থাইক্যা রাস্তা দিয়া আর নদী পথে পাক-বাহিনী আর রাজাকরা এই গেরামডা প্রায় ঘিইরা ফ্যালাইছে। পোলাপান লইয়া যেইদিকে পারেন, তাড়াতাড়ি পলাইয়া যান গো চাচি! আইজ আর রক্ষ্ ানাই! রেলগাড়ি ভইরা ঢাহাত্যে মিলিটারি আইছে। আমি এই খবরটা দেওনের লাগিই কাওরাইদতে এক দৌড়ে এইহানে আইছি।
সংবাদটা শোনার সাথে সাথেই জাহানারার আব্বা-আম্মা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে শুধু দক্ষিণ দিকে দুর্ঘম পথে ছুটতে থাকে। যাওয়ার সময় জাহানারার আম্মা ঠাকুরবাড়ির বাদলের মাকে বলল, দিদি! আইজ আর উপায় নাই। তাড়াতাড়ি যেদিকে পারেন, পালান; মিলিটারি কিন্তু আইসা পড়ছে।
জাহানারার আম্মার কথাগুলি বাদলের মা আমলে নিলো না। বরং জবাবে বাদলের মা জাহানারার আম্মাকে বলেন, কয়দিন পর পর কমলার মা কী যে কাণ্ড করে! পোলাপান, পুটলা-পুটলি আর গরু-ছাগল লইয়া শুধু শুধু দৌড় পাড়ে।
বাদলের মা বুঝতে পারেনি যে, তাদের জন্য ভয়াবহ এক ধ্বংসযজ্ঞ এবং নির্মম পরিণতি অপেক্ষা করছে। পালালে হয়তো বা ধন-সম্পদ বিনষ্ট হলেও অন্তত প্রাণে বাঁচতে পারতো পরিবারের সব সদস্যই। এক্ষেত্রে জাহানারার আব্বা-আম্মা অবশ্য তখন ওড়াকথা বা গুজবকেও গুরুত্ব দিতেন। কারণ, তাঁরা যত না জীবনের মায়া করতেন, তারচে’ বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন মেয়েদের নিয়ে। কারণ, জাহানারা তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। তার বড় দুই বোনের একজন ছিল এসএসসি পরীক্ষার্থী, আর একজন কলেজে পড়তো। ওরা নরপশুদের সামনে পড়লে তো নিস্তার পাওয়ার কোনো উপায় থাকতো না। এই দুর্ভাবনায় জাহানারার মা ও বাবা ছিলেন উৎকণ্ঠিত। সেদিন ওরা জামিরা পাড়া হয়ে খিরু নদীর ওপারে চলে গিয়েছিল।
সত্যি সত্যি সেদিন হানাদার বাহিনী আর তাদের দোসর রাজাকাররা চারদিক থেকে গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। প্রথমে আক্রমণ চালায় হিন্দুপাড়াকে টার্গেট করেই। তখন আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসাবে প্রতি বাড়ি বাড়ি ব্যাঙ্কার তৈরি করা হয়েছিল। পাক হানাদারদের পৈশাচিক আক্রমণে দিশেহারা হয়ে হিন্দু পাড়ার বেশিরভাগ সদস্য ব্যাঙ্কারে আশ্রয় নেয়। কেউ যদি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে, তবে তাকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে ওরা।  বাড়ি বাড়ি দিয়েছে আগুন। প্রাণভয়ে ব্যাঙ্কারে আশ্রয় নেওয়া নিরস্ত্র শিশু-নারী-পুরুষ-কিশোর-যুবা-বৃদ্ধকে ব্রাশ ফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। শুধু হিন্দুপাড়া আক্রমণ করেই ক্ষান্ত থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধ সমর্থকারী মুসলমান বাড়িও বাদ যায়নি। সব শেষে গ্রামের প্রান্তের ঠাকুরবাড়িতে ঢুকে ওরা। ভীত-সন্ত্রস্ত বাদলের মা-বাবা, ভাই-বোনেরা সবাই তখন ঠাঁই নিয়েছিল ব্যাঙ্কারে। পাকবাহিনীর সদস্যরা ওদের বাড়িতে ঢোকামাত্র প্রাণভয়ে তটস্থ হয়ে যায় ব্যাঙ্কারবাসীরা। বাদলের মা তার মেধাবী ছেলে দিলিপকে আঁচলের তলে ব্যাঙ্কারের এককোণে লুকিয়ে রাখে। আর বাদল ছিল বাবার আড়ালে লুকিয়ে। ছিল ওদের ফুটফুটে ছোট দুটি বোন। মুহূর্তের মাঝে ব্রাশ ফায়ারে সব শেষ। বাদলের বাম বাহুতেও একটা গুলি লেগেছিল। প্রাণভয়ে সে মরার ভান করে স্বজনদের লাশের সাথে পড়েছিল। চোখের সামনে মা-বাবা, বড়ভাই ও ছোটবোন দুটির মৃত্যু দেখেছে সে। দেখেছে তাদের ধড়ফড়ানি। মনে হয়েছিল সেও বুঝি মরে গেছে। কিন্তু যখন বুঝতে পারলো তার বাম বাহুতে কেবল গুলি লেগেছে এবং অবিরাম রক্ত ঝরছে; তখন তার আত্মরক্ষার চিন্তা আসে মাথায়। সে সময়ে তাদের বাড়িতে লুটেরা রাজাকাররা লুণ্ঠন চালাচ্ছে। ঠিক তখনি বাদল দৌড়ে পালাতে যাচ্ছিল। সামনে পড়ে এক রাজাকার সদস্য। তাকে দেখে ভয়ে ঝোপের আড়ালে লুকাতে যাচ্ছে বাদল। তখন রাজাকার সদস্যটি চারদিক তাকিয়ে দেখলো, স্বপক্ষের কেউ কাছে নেই। এ ফাঁকে রাজাকারটি বলে, শোন বাদল! তোর তো এখন হিতাহিত জ্ঞান নাই। ভালোভাবে খেয়াল করে দেখ, আমি তোর সহপাঠী জামাল।
-জা-মা-ল!
বলেই থমকে দাঁড়ায় বাদল। জামাল কাছে গিয়ে নিচু স্বরে বলে, এমনে দৌড়াদৌড়ি করলে বাঁচতে পারবি না। গ্রামে এখন শত শত মিলিটারি। তুই বরং ঐ পুকরের পানিতে নাইমা যা। মিলিটারিরা তোর হাতের রক্ত ঝরতে দেইখ্যা জিগাইলে কইবি, মুক্তিবাহিনীরা গুলি করছে। আর নাম জিগাইলে আসল নাম কইবি না। যা তাড়াতড়ি পানিতে নাইমা যা।
বলেই রাজাকার সদস্যটি সরে যায়। বাদলও ততক্ষণে পুকুরে নামে। ঠিকই কিছুক্ষণের মাঝে ক’জন পাকসেনা এসে তাকে পানি থেকে ডেকে তুলে। উর্দুতে জিজ্ঞেস করে, কারা হাতে গুলি করেছে?
জবাবে বাদল বালে যে, মুক্তিবাহিনীর গুলিতে সে আহত হয়েছে। বাদলের কথা শুনে ওরা নিজেদের মাঝে কী যেনো বোঝাপড়া করে, তারপর বাদলকে আর কিছু না বলে চলে যায়।
গল্পের এ পর্যায়ে এসে জাহানার ম্যাডাম বলে, এই সেই বাদল। এদেশের স্বাধীনতার জন্য কত মানুষ-কতভাবে যে কতকিছু হারিয়েছে, তার সঠিক খতিয়ান কি আজও প্রণয়ন হয়েছে?
জবাবে একটা দীর্ঘ নি:শ^াস ত্যাগ করে হাসিনা বেগম বলে, এমন কতো গল্প যে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে-তার কি কোনো হিসাব আছে!

0 comments:

Post a Comment