Friday, July 31, 2020

ইসরাফিলের শিঙ্গায় ফুৎকারের পরে , গল্প (সাইফ সিরাজ)



ইসরাফিলের শিঙ্গায় ফুৎকারের পরে
সাইফ সিরাজ 

এক.
ইসরাফিলের সিঙ্গায় শেষ ফুৎকার হয়ে গেছে। মানুষেরা ছুটছে। ভীত-সন্ত্রস্ত। কেউ কারো নয়। পিতা পুত্রের নয়। স্বামী স্ত্রীর নয়। ভাই ভাইয়ের নয়। বন্ধু বন্ধুর নয়। চিন্তা-চেতনায়, মনে-মগজে একটাই ধ্বনি ‘ইয়া নাফসী’‘ইয়া নাফসী’। কেউ ছন্নছাড়া। কেউ উদ্বিগ্ন। কেউ আবার বিষণ্ন। একটা কঠিন এবং অনিবার্য বিপদের মুখোমুখি পৃথিবী নামক গ্রহের প্রবল প্রতাপশালী বুদ্ধিমান প্রাণীকুল। এখানে সব পথ আর মত এসে মিশে গেছে নির্ভুল আদালতের এজলাসে।সক্ষম আর অক্ষম, শঠ আর কুচক্রী, কৃতজ্ঞ আর কৃতঘ্ন, বিশ্বস্ত আর বেঈমান, হন্তারক আর শহীদ সবার অপেক্ষা চলছে এখন নির্জীব সাপের মতোন। কেউ অনুশোচনায় দগ্ধ, কেউ অনাগত আগুণের ভয়ে ক্ষত-বিক্ষত। কেউ পরম প্রিয়ের সান্নিধ্যের অপেক্ষায় আকুল ব্যাগ্র। কেউ আবার ডানামেলা নির্ভার; যেন এক সুখী পায়রার অপার আনন্দ-জীবন।পৃথিবী নামক ট্রেনের যাত্রাপথের হিসেব নিতে ‘ওয়াহিদুল কাহহার’ শুরু করেছেন হিসেবের কাজ। একে একে সবার আমলনামা দেখা হচ্ছে। আটকে যাচ্ছে অনেকেই। কেউ আবার বিনা হিসেবেই পার পেয়ে যাচ্ছেন। এ এক অবর্ণনীয় কঠিন সময়!

দুই.
জান্নাত জাহান্নাম নির্ধারিত হচ্ছে। এক দল ফেরেশতা কিছু মানুষকে হাঁকিয়ে নিচ্ছে অনন্ত আগুনের দিকে। আগুনের পথে চলন্ত মানুষের চোখে-মুখে ভয়ের বিজ্ঞাপন। ভীত-লজ্জিত মানুষেরা আফসোসের তীব্রতায় নিজের আঙুল কাটছে নিজের দাঁতে। তিমির অনল পাথরের ইন্দনে জ্বলছে। এই দলে আছে জালিম, ধর্ষক, খুনি, প্রতারক, অবিশ্বাসী আরও আরও অপরাধের আসামী।কোন কোন দল একটা দুইটা পুণ্যের জন্যে আটকে যাচ্ছে। একটা পুণ্য পেলেই তার পুণ্যের পাল্লা ভারি হয়ে যেতো! তারা আবার ছুটছে ‘ইয়া নাফসী’‘ইয়া নাফসী’ বলে এক হাহাকার ভরা শব্দের কোরাস গেয়ে গেয়ে। কেউ আটকে যাচ্ছে কোটি মানুষের দাবীর কাছে। কারো আবার রক্তের দাবীর কাছে আটকে গেছে সারাজীবনের অর্জন। কারো অর্ধেক জীবনের তাওবা কবুল হয়েছে। কারো পুরো জীবনের তাওবা কবুল হয়েছে কয়েকটা মিনিটের তাওবা ছাড়া। এরা জীবনের সকল পুণ্যের সম্পদ নিয়ে ছুটছে ক্ষমার আশায়। কেউ একজনের কাছে ক্ষমা পেতেই শেষ করে দিচ্ছে এক জীবনের অর্জিত সকল পুণ্য। আর কোটি জনতার ক্ষমার কথা ভাবতেই ভীত-নির্জীব-কাঠ হয়ে গেছে। এদের মধ্যে কেউ ছুটছে রক্তের দাবী মিটিয়ে ক্ষমার আশায়। পুরো জীবনের তাওবা কবুল হয়েছে। পুরো জীবন শুধু পুণ্যের পথেই চলেছে; কেবল কয়েকটা মিনিট ছাড়া। এই কয়েকটা মিনিটে যে রক্তের দাবী তার আমলনামায় ছিল; সেই রক্তের দাবী মেটাতে গিয়ে এক ফোটা রক্তের দাবী মেটাতেই সারা জীবনের অর্জন শেষ। রক্তের দাবী ছিল এক সাগর। রিক্ত-শূন্য-দীন হয়ে উদ্বিগ্ন খুনির মুখেও চলছে; ‘ইয়া নাফসী’‘ইয়া নাফসী’ ত্রস্ত কোরাস! এবার ছুটছে, সক্ষমতার পরও অক্ষমের আর্তনাদ না শুনে; জালিমের জন্য নিরব থাকা একদল। ওরা আরও বিভ্রান্ত। আরও সন্ত্রস্ত। এদের বুকে কেবল হাতুড়ি পেটার শব্দ। নিরাপদ আর নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের লোভে, প্রবল প্রতাপের প্রত্যাশায় তারা যে আজদাহা লালন করেছিল। সেই আজদাহা আজকে তাদেরকেই গিলে নিচ্ছে। তাদের দান-অনুদান, লৌকিক ধর্ম-সেবা, মিডিওকার ঈমানদারী তাদের মুক্তির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফেরেশতা হাঁকিয়ে নিচ্ছে। তারা পুণ্য পাওয়ার লোভে তাদের ঘৃনায় ভষ্ম শহীদের কাছেই হাত পাতছে। কিন্তু তাদের হিসেবের আমলনামা ক্রিটিক্যাল। তাদের বিচারের রায় তাদের প্রত্যাশার বিপক্ষে। মুক্তির সম্ভাবনা শূন্য। অগণিত হতাশায় মানচিত্রের মতো রেখা ফুটে উঠেছে তাদের চোখ আর মুখে। হাহাকার আর হতাশার অতলে নিমজ্জিত প্রবল প্রতাপের ক্ষমতাশীন।

তিন.
আল্লাহর আদালতের ডান পাশে শহীদ আর বাম পাশে খুনিদের দল দণ্ডায়মান। নির্ভার শহীদের চোখে মুখে আনন্দের ঢেউ। খুনিরা অসহায় চাহনিতে দাঁড়িয়ে। বিচারের রায় হচ্ছে। এক এক করে খুনিরা দোযখের রায় পাচ্ছে। ফেরেশতাগণ হাঁকিয়ে নিচ্ছে খুনিদের। গল্পের এই পর্যন্ত এসে বর্ণনাকারীর চিন্তা নেমে আসে মর্ত্যরে পৃথিবীতে। ইতিহাসের এক নির্মম অধ্যায়ে হারাতে থাকেন বর্ণনাকারী। এক শহীদের জীবনের ভেতরে চলতে থাকে বর্ণনাকারী সফর। যেখানে একজন নয়! দুই জন নয়! একে একে নির্মম বুলেটের আঘাতে শহীদ হয়েছিলেন একটি পরিবার; একটি স্বপ্ন। শহীদ হয়েছিল একটি পতাকার সহাস্য উড্ডয়ন স্বাধীনতা। স্তবির হয়েছিল একটি জাতির জেগে ওঠার অদম্য উদ্দীপনা। শহীদ হয়েছিল একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতার স্বাদ। শহীদ হয়েছিল এক অদম্য সংগ্রামীর গৌরবের জয়যাত্রা।

চার.
কৈশোরের চপলতা কেটে যাওয়ার আগেই যিনি মানুষের জন্য জেল কেটেছেন। একটি জাতির স্বাধীনতা আর একটি মানচিত্রের জন্য যিনি শত্রুর বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে বরণ করেছের মৃত্যু উপত্যকায় নির্বাসন।  যাঁর বজ্র-গমগম আওয়াজ আর অনমনীয় তর্জনীর ইশারায় জেগে ওঠেছিল এমন এক জাতি। যাদের জীবনের ইতিহাস মানেই মটরশুঁটি পুড়ানোর আয়োজন। নবান্নের উৎসবে মায়া মায়া চেহারায় স্বজনের আপ্যায়ন। ফসলের খেতে রৌদ্রঝলকে নির্মল হাসি।  যাঁদের চেনা অস্ত্র বলতে বল্লম, টেঁটা আর কাস্তে। তারাই হাতে নেয় অদম্য সাহসে অচেনা বারুদ। জেগে ওঠে স্বাধীনতার সুপ্ত স্বপ্ন। স্লোগান ওঠে ‘জয় বাংলা’। জেগে ওঠে প্রতিবেশ। জেগে ওঠে বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, চপল কিশোরী, আর পঙ্কিরাজের অপেক্ষায় থাকা তরুণী। এক অসম যুদ্ধের ময়দানে আনকোরা যোদ্ধার জয়ভেরি বাজে। প্রেরণার পালে হাওয়া দেয় সাত মার্চের বজ্রবয়ান। মগজের নিউরণে অনুরণন তোলে “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তারুণ্যের রক্তে জেগে ওঠে, “রক্ত যখন দিয়েছি আরো দেবো। তবুও এদেশকে স্বাধীন করে ছাড়বো। ইন শা আল্লাহ্।” এই অজেয় আর অদম্য সাহসীর বুকের অমিত আগ্নেয়গিরি, চোখের শীতল অথচ মর্মভেদী চাহনি, মগজের বলিষ্ঠ অনুভবে জেগে ওঠে মুক্তিকামী জনতার সাহস। যুদ্ধের ময়দানে নেমে আসে মানুষ। জলপাই রঙের দানবেরা তখন ইতিহাস ভুলে, আইন ভুলে, ভুলে তাদের পরিচয়। ভুলতে ভুলতে বরণ করে পরাজয়। উদিত হয় স্বাধীনতার সূর্য। সূর্যের গায়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদের খুন।

পাঁচ.
আমাদের নায়ক। আমাদের নেতা। বুলেট আর বেয়নেট জয় করে ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে। একটা সোনার স্বদের গড়ার অদম্য প্রত্যয়ে ছুটতে থাকেন লক্ষ্যের পানে। পৃথিবীর তাবৎ অভিজাত আর যোদ্ধা জাতির অবাক পর্যবেক্ষণে গর্বিত এক জাতি হিসেবে নতুন মানচিত্রে জেগে ওঠে বাংলাদেশ। সংগ্রামী নেতার সংগ্রাম চলতে থাকে সদ্য স্বাধীন এই ভূখণ্ডের পূণর্গঠনে। মানুষ ফিরতে থাকে নিজের ঘরে। আস্থা আর ভালোবাসায় জাগতে থাকে একটি জাতি। স্বজন হারানোর বেদনা বুকে চেপে স্বদেশ গঠনে নামে আপামর জনতা। চলতে থাকে রূপকথার এক বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা।

ছয়.
ঊনিশ শো পঁচাত্তর সাল। নেতার কাছে গোয়েন্দা রিপোর্ট আসে। নেতা নেতার মতোন বলে দেন, “আমার মানুষ আমাকে মারতে পারে না”। এই নেতা কোন নেতা? যিনি একটা তর্জনীর ইশারায় একটা জাতির স্বাধীনতা এনেছেন। যিনি একটা বজ্রবয়ানে সাড়ে সাতকোটি জনতাকে জাগিয়েছেন। সেই নেতার আত্মবিশ্বাস থাকবে না তো থাকবে কার! কিন্তু! কৃতঘ্নদের আসলে এতসব দেখার সুযোগ কোথায়! ওদের দেখার চোখ অন্ধ। উপলব্ধির হৃদয় স্তব্ধ। ভাবনার মগজে দুর্গন্ধ। উপলব্ধির দুয়ারে ঘৃণার তালা। ফলে ওরা অস্ত্র হাতে নেয়। খুন করে একটি সম্ভাবনা। একটি ইতিহাস। একটি সভ্যতা। একটি কিংবদন্তি। একটি মানুষ নয় একটি দেশকে হত্যা করে ওরা। বঙ্গবন্ধুর রক্ত কেবল বঙ্গবন্ধুর রক্ত নয়। আজকের ষোলকোটি মানুষের স্পন্দন। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের হৃদস্পন্দন। বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধ মানে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলের একটি মানচিত্র। এরপর থেকে ওরা জাতীর কাছে ঋণী। মাটির কাছে ঋণী। প্রকৃতির কাছে ঋণী। নদীর কাছে ঋনী। রক্তের কাছে ঋণী। ওদের এই ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। ওরা খুনের সুফল পেতে আরোও খুনে মেতে ওঠে। খুনের দায় নিয়ে ওরা পারি দেয় ইহজগত হতে টর জগতের চূড়ান্ত বিচারের এজলাসে। 

সাত.
ইসরাফিলের সিঙ্গার শেষ ফুৎকারের হয়ে গেলে; শহীদের সঙ্গে খুনিরাও উঠে আসে হাশরের ময়দানে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার চলতে থাকে। একে একে সবার বিচার শেষ। খন্দকার মোশতাকের বিচার এখনও বাকি। সকল খুনি ভাবছে এই বুঝি তার ক্ষমা হয়ে যায়!পিনপতন নিরবতা। তার পূণ্য আর পাপের পাল্লা সমান সমান হতে হতে;ঘোষণা আসে কেবলমাত্র একজনের কাছে ক্ষমা চাইলেই তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। এইবার সকল খুনি তাকে ঘিরে ধরে। সে কোন কথা বলে না। তার মুখে কেবল ‘ইয়া নাফসি’‘ইয়া নাফসি’। এমন সময় মেজর ডালিম বলে, ‘মুমিনকে হত্যা করা কুফরি’ আমরা কুফরির পাপে নিমজ্জিত। আমাদের কী হবে? হঠাৎ খুনিদের মুখে হাহাকার ভরা আকুতি নেমে আসে ‘ইয়া নাফসী’‘ইয়া নাফসী’। পৃথিবীর জীবনে এরা অনেক তাওবা করেছে। অনেক দান করেছে। অনেক সাদকাহ করেছে। আজকের এই মহা হিসাবের দিনে সব কিছুর পরিমাণ মিজানের পাল্লায় তুচ্ছ হয়ে গেছে। তাদের সবাইকে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর খুন, পুরো পরিবারের খুন আর কেয়ামত পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল মানুষের আফসোসের ক্ষমা যদি নিতে পারে তাহলেই কেবল তাদের মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। দুনিয়াতে যাদের বিচার হয়েছিল। ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল। তারা একটা আর্গুমেন্ট দাঁড় করাতে চায়। তারা বলে, “আমাদের তো বিচার হয়েছে! তাহলে আমরা কেন দ্বিতীয়বার বিচারের মুখোমুখি হচ্ছি! আওয়াজ আসে, “তোমাদের তো কেবল ব্যক্তি হত্যার বিচার হয়েছে। ব্যক্তিত্ব হত্যার বিচার হয়নি! স্বপ্ন হত্যার বিচার হয়নি! একটা মানচিত্র ক্ষত-বিক্ষত করার বিচার হয়নি। নিষ্পাপ শিশু হত্যার বিচারও হয়নি।” ‘ইয়া নাফসী’‘ইয়া নাফসী’ বলে খুনীরা দৌড়াতে থাকে বঙ্গবন্ধুর খোঁজে। ওদের অন্ধ চোখ খুঁজে পায় না শহীদ বঙ্গবন্ধুকে। এমন সময় খন্দকার মোশতাক বলে, “আরেহ নেতা তো শহীদ। তাঁকে তো শহীদের দলে পাওয়ার কথা!” ভীত-আতঙ্কিত খুনিরা দৌড়াতে থাকে। পিপাসার্ত, ক্লান্ত-শ্রান্ত খুনিরা ক্ষমার আশায় ছুটছে তো ছুটছেই!

আট.
এমন সময় অসহায় জনতা ওদের দেখে। যারা অসহায় হওয়ার কারণে পাপ করতে ভয় পেতো। আল্লাহর ভয়ে খুনিদের বিচার চাইতো। আর খুনিরা তাদেরও খুন করে ফেলতো। তারা জান্নাতের প্রমোদকাননে বসে ওদেরকে উপহাস করছে। তারা তাদের কৃতকর্মেরপ্রতিফল পাচ্ছে। এই দেখে যারা আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছিল, নিজেদের অক্ষমতার কারণে; তারা আজ আনন্দিত। কৃতজ্ঞ মহান রবের কাছে।

নয়.
‘ইয়া নাফসী’‘ইয়া নাফসী’ বলে আর্তনাদ করতে করতে খুনিরা খুঁজে পায় শেখ সাহেবকে। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীকে। শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলসহ ওদের রক্ত নেশায় শহীদ শেখ পরিবারের সবাইকে। শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব প্রশ্ন করেন। ওরা কোন উত্তর দিতে পারে না। শেখ রাসেলের কোমল প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারে না। কারো প্রশ্নেরই কোন উত্তর দিতে পারে না। লজ্জায় ওদের দেহের কোষে কোষে নেমে এসেছে অন্ধকার। বোবা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। কেন এসেছে, কী চাইতে এসেছে, কার কাছে এসেছে সব ভুলে পাথর হয়ে গেছে।  বঙ্গবন্ধু হাঁক ছাড়েন, “কীরে তোরা যেমনে পাথর হয়া খাড়ায়া রইছোস জাহান্নামের ইন্ধন হওয়া ছাড়া তো কোন গতি দেখতাছি না!” এইবার খুনিদের টনক নড়ে। নিজেদের বিপদের কথা বলে। পুণ্যের বিনিময়ে ক্ষমার আবদার জানায়। 
বঙ্গবন্ধু বলেন, “তোরা তো দুনিয়াতে মাফ চাওয়ার কোন পথ রাখলি না। তাইলে তো এমনিতেই মাফ কইরা দিতাম। কিন্তু একটা কথা কি জানোছ? আমি একজন মানুষ। পাপে-পুণ্যের মানুষ। মাবুদের কাছে হিসাবের আদালতে আটকাইলে না জানি কী হইতো! অথচ তোরা আমারে শাহাদাতের মৃত্যু দেওয়ার জন্য মাবুদ তো আমারে মাফ কইরা দিছে। তোরা তো আটকায়া গেলি!” এই বলে তিনি তাঁর স্বভাব সুলভ ভূবন ভোলানো হাসিটা দিলেন। খুনিদের একজন ভাবলো এইবার হয়তো তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। তার এই ভাবনার আগেই বঙ্গবন্ধু আবার বলতে শুরু করেন, “কিন্তু সমস্যা হইলো, আমার রাগ-ক্ষোভ সব হজম হলেও; মাবুদের রাগ-ক্ষোভের দায় তো আমি নিতে পারবো না। যেমনভাবে বান্দার রাগ-ক্ষোভের দায় মাবুদ নেন না। নেওয়ার অনুমতিও পাবো না। ফলে আখিরাতের নিয়মে তোমরা ক্ষমা চাও এবং নাও।
দশ.
একে একে সবার সকল নেকির বিনিময়ে এক ফোঁটা খুনের ক্ষমা লাভ করেছে। খন্দকার মোশতাক তাঁর সকল পুণ্যের বিনিময়ে একটা হত্যার ক্ষমা পেয়েছে। অসহায় হাহাকার আর ভীত-আতঙ্কিত হয়ে তাদের কণ্ঠে আবার ধ্বনিত হতে থাকলো ‘ইয়া নাফসী’‘ইয়া নাফসী’।

এগারো.
ফেরেশতাগণ এবার খুনিদের জাহান্নামের দিকে হাকিয়ে নিচ্ছে। আর বলছে, “দেখো এক জীবনের পূণ্যের আয়োজনে এক ফোঁটা রক্তের ঋণ শোধ করেছো কেবল। অথচ তোমাদের জিম্মায় অগুণিত রক্ত-ফোঁটার ঋণ। একটা জাতির প্রত্যাশা ভঙ্গের ঋণ। পিতৃহারা দুই কন্যার অব্যক্ত যাতনাময় জীবনযাত্রার ঋণ। তোমাদের লালসা আর ক্ষমতার শিকার অসংখ্য আম জনতার ঋণ। প্রেমার্ত জনতার ভালোবাসার মিনার ধ্বসের ঋণ। ‘একজন মুমিনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা পুরো মানবজাতিকে হত্যা করার সমান’ অপরাধের ঋণ। তোমাদের তো পুণ্যের পুঁজি শেষ। এই অসীম ঋণ আর কী দিয়ে শোধ করবে!” জাহান্নামের পথে চলতে চলতে খুনিদের উপলব্ধি হয়। হায়! যদি আবার ফিরে যেতে পারতাম। আবার ফিরে যেতো বঙ্গবন্ধু। তাহলে হয়তো তিনি ‘আমার অমুক’‘আমার তমুক’ বলে ক্ষমা করে দিতেন!

0 comments:

Post a Comment