Friday, July 31, 2020

শুধুই বঙ্গবন্ধু , গল্প ( দীলতাজ রহমান)


শুধুই বঙ্গবন্ধু
দীলতাজ রহমান 
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার কোনো পড়াশোনা নেই। তাঁকে নিয়ে আমি বানিয়ে কোনো গল্প লিখতেও পারবো না। কারণ দিনে দিনে যে সত্যকে প্রাণে স্পর্শ করেছি, তাতে কল্পনার রঙ চড়িয়ে সংলাপ বসানোর সাধ্য আমার নেই।  অচেনা কাউকে নিয়ে ভালমন্দ যা খুশি লেখা যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অন্যদের বানানো কোনো গল্পওআমার পড়া সহ্য হয় না! কারণ অস্তিত্বের উৎস কাউকে নিয়ে কল্পিত কিছু কার সহ্য হয়!
আমার জন্ম ১৯৬১ সালে। দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর হাঁকডাকের ভেতরই আমার বেড়ে ওঠা। আমার চেতনার পরিবর্ধিত হওয়া!আমরা তখন খুলনাতে। সত্তর সালের কোনো একমাসে আব্বা বাড়ি গিয়েছেন। এর ভেতর গভীর এক রাতে হঠাৎ আমার মা কাঁপতে কাঁপতে আমাদের তিন বোনকে ঘুম থেকে টেনে নিয়ে ছুটলেন, বাড়িওয়ালার বাড়ি। বিশাল পুকুরের ওইপাড়ে বাড়িওয়ালার মাত্র দু’টি রুম। শ’দুয়েক ভাড়াটিয়া আমাদের সবার সারবাঁধা গোলপাতার ঘর। মুখোমুখি রান্নাঘর। আর রান্নাঘর আর থাকার ঘরের মাঝখানে  সরু মাঠের মতো দীর্ঘ উঠোন।বেশ দূরে বাড়িওয়ালার বাড়ির কাছে একটি মাত্র টিউবয়েল। আর সব বাড়ির মাঝখানে দীঘির মতো এক পুকুর। সেসব পেরিয়ে একমাত্র বাড়িওয়ালার দুটি রুমই ছিল ভরসার পরম স্থল। কারণ তা ছিল ইটের। বছর নয়েকের আমি দেখলাম, আগেই সে দু’টিরুমে শুধুকোলের শিশুসহ মহিলাদের দ্বারা উপচে তো পড়ছেই,বারান্দা ছাড়িয়ে বাইরে পুরুষরা বাকি ছেলেমেয়ে নিয়ে কেন্নোর মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে বসে আছে। সময়টা মনে হয় শীতের ছিল। অথবা ভয়েই সবাই অমন ঠকঠক করে কাঁপছিল।অথচ নিরস্ত্র এইসব মানুষের দিকে ধেয়ে আসছে, অস্ত্রসহ পাঞ্জাবি-বিহারিরা। খুব হাঙ্গামা শোনা যাচ্ছিল। তখন থেকেই আল্লাহ্’র নামের সাথে মুজিবের নাম জপতে দেখছি মানুষকে। বাঙালি জাতির উদ্ধারকর্তা হিসাবে আর কেউ ছিল না সে নামের পাশে।
একাত্তর সালের প্রথম দিকেই আমরা আমাদের বাড়ি গোপালগঞ্জ হয়ে ঢাকাতে চলে আসি। বাসা নেয়া হলো টঙ্গী নোয়াগাঁও এম, এ, মজিদ মিয়া স্কুলের ঠিক সামনে। ওই স্কুলেই আমার ভাইকে ক্লাস সিক্সে, আর আমাকে ক্লাস থ্রীতে ভর্তি করা হলো। যথারীতি লেখাপড়া আর হেসেখেলে আমরা দিন গুজরান করছিলাম।কিন্তু পঁচিশে মার্চের ঠিক তিনদিন আগে, দুপুরে আব্বা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে বললেন, ‘পাকিস্তানীরা গোলা-বারুদ, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের দেশে ঢুকে পড়েছে। আর রক্ষা নেই। রক্ত ছাড়া কোনো জাতির স্বাধীনতা আসে না। আমাদেরও রক্ত দিতে হবে।’
এইসব কথা বলতে বলতে আব্বা নিজেই ঘরের মেঝেতে বিছানার একটা চাদর বিছালেন। তারপর তার ভেতর আমাদের কাপড়চোপড় যা ধরে, তাই বাঁধলেন। এর ভেতর মা বানালেন, এক কড়াই আটা সিদ্ধ করে কোনোরকম তা ছেনে যে একবোঝা রুটি বানালেন, তার সবই কোনা টুটা-ফাঁটা। আর রুটির সাথে নেয়ার জন্য খোসা না ফেলে ধাগড়া ধাগড়া করে কাটা আরেক বোঝাআলুর ভেতর চুবানো পানি দিয়ে নুন, হলুদ, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ দিয়ে জ্বাল দেয়া শুরু করলেন। শুধু তা সিদ্ধ হতে যতক্ষণ। তারপর আমরা যে যে অবস্থায় ছিলাম, সেভাবেসদরঘাট নিয়েএনে লঞ্চে ওঠালেন। বিকেল নাগাদ লঞ্চ ছাড়লো। পরদিন বিকেল নাগাদ সে লঞ্চ গোপলগঞ্জ হরিদাশপুরের ঘাটে এসে ভিড়লে আমরা তখন ত্যানাত্যানা অবস্থায় নামলাম। তারওপর আছে সবার হাতে কিছু না কিছু বোঝা! লঞ্চের ওই দীর্ঘ সময়ে ভয় এবং ক্লান্তিতে আমাদের সবার চেহারা রিফিউজি দশা হলে গিয়েছিল। গ্রামের পথ দিয়ে প্রথম ওভাবে দুর্গত অবস্থায় কাউকে আসতে দেখে সাধারণ মানুষ একটু তাজ্জব হচ্ছিল। আমাদের চেনা যারা সেদিন খাগাইলের খাল থেকে মাছ ধরেআসছিল, অথবা ক্ষেতে কাজ করছিল, তারা সবাই আশ্চর‌্য হয়ে তাকিয়েছিল।  তারা ভাবছিল, এই মাত্র মাস দুয়েক আগে আমরা ঢাকা গিয়ে কেন আবার এভাবে ফিরে এলাম! কারণ তখন ঢাকা যাওয়া-আসা চাট্টিখানি কথা ছিল না। কেউ ঢাকা গেছে, এমনটি জানলে, তার প্রতি সবার যে সমীহ ঝরতো, এখন কেউ আমেরিকা থেকে ফিরেছে জানলেও আমরা সে সমীহ কারো জন্য কারো খুঁজে পাই না! আর তখন সবার খোঁজ সবার এমনিই রাখাও হতো।
আগে দূরে থাকা কেউ বাড়িতে ফিরে এলে, সারাবাড়ির মানুষ ছুটে আসতো তাকে দেখতে। আমাদের জন্যও আমাদের বাড়ির প্রায় চল্লিশ ঘর মানুষের সব বয়সের সবাই প্রায় ছুটে এল। আব্বা সবার কাছে আমাদের ফিরে আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। বললেন, পাকিস্তান থেকে জাহাজ ভর্তি করে অস্ত্রসস্ত্র-গোলা-বারুদ চলে এসেছে। যে কোনো সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেৃ।’ তখনি  সবাই আব্বাকে উপহাস করতে লাগলেন, ভীতু বলে।  বাড়ির মানুষের এইকথা পাশের সব বাড়িতে গিয়ে পৌঁছুতে দেরি লাগল না। তারপর তা রটলো হাটে-বাজারে, যে ‘জহুর ভূঁঞা একটা ভীতুৃ!’  কিন্তু তিনদিনের বেশি রটনার ধার থাকলো না।  এক রাঙা সকালে দেখা গেল, আমাদের পাশের দুই গ্রাম, বিজয়পাশা এবং পাইককান্দিতে বিভিন্ন বাড়ি দাউ দাউ আগুনে জ্বলছে! আকাশ ছোঁয়া ছিল তার শিখা।প্রতিটি বাড়িতে খড়ের পালা থাকায়, সে আগুনের চেহারা কি বিভৎস ছিল, তা বর্ণনার ভাষা নেই। 
যে ভাই আর আমি একসাথে টঙ্গীর নোয়াগাঁও স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম, সে ছিল আমার সৎভাই। এমনিতে আমরা দুই মা’য়ের ঘরে বোন ছিলাম দুইহালি। আর ভাই সবেধন নীলমনি ওই একটাই। তাও আবার আমার সৎ। তাই সম্পর্কটা শত্রুতা ও মিত্রতায় মিশ্র ছিল। আমার থেকে সেভাই বছর তিনেকের বড়। সে আর আমি একজন আরেকজনের কাঁধে হাত রেখে হাঁটতাম। আমাদের একজনের যদি খেতে খেতে পায়খানায় যেতে হতো, আরেকজনও বলতাম, ‘আমিও যাবো। আমারও পায়খানা আসছে।’পায়খানা বলতে আমরা যেতাম ডাঙায়। বাড়ির সামনে আমাদের চষা জমিতে।পাশাপাশি বসে দুইভাইবোন পায়খানা করতে করতে কত যে গল্প করতাম। গল্প ফুরালেই আমাদের মনে পড়তো পায়খানা বহু আগে শেষ হয়ে গেছে। তারপর পাশের পুকুর থেকে পবিত্র হয়ে দু’জনের রেখে যাওয়া মাখনো ভাত দু’জনে একসাথে মিলিয়ে খেতাম। এমনি ছিল পিঠোপিঠি সে সৎভাইয়ের সাথে আমার ভাব। আর এই ভাবের কথা এখানে বলা এজন্য যে, সে না থাকলে জীবনের অনেক কঠিন বোধ আমার অস্ফূট থেকে যেত।এই লেখাটি যেভাবে শুরু করেছি, তাতে দেখছি, যে বিষয় নিয়ে লিখতে চলেছি, তাকে না আনলে আমার চলছে না!
‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম! এবারের সংগ্রামস্বাধীনতার সংগ্রামৃ।’ দুইভাইবোনের একজন বঙ্গবন্ধু হতাম। আরেকজন সামনে দাঁড়িয়ে হতাম শ্রোতা! দিনভর এই খেলা আমাদের দু’ইজন ছাড়া আমাদের আর কারো সাথে জমতো না! একাত্তরের তখন সারাদিন ধরে আমরা দু’ভাইবোন বঙ্গবন্ধুর নামে আরো যত ছড়া ছিল, বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষণ ছাড়াও, তা আমরা আমাদের মতো করে বলে বেড়াতাম। এই, ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা বোয়াল মাছের দাড়ি/ ওয়াহিদুজ্জামান চাকর থাকবে শেখ মুজিবের বাড়িৃ।’ আবার ওয়াহিদুজ্জামেনর জায়গায় ভুট্টো, টিক্কার নামও জুড়ে নিতাম। কিন্তু আসল লেখাটিতে নাম কার তা আজও জানি না। তাই এখনো একে একে আমাদের স্বাধীনতার সব শত্রুদের নামই আউড়ে যাই চাকরের চরিত্রে!
আর বঙ্গবন্ধু? বঙ্গবন্ধুই বরপুত্র, তাঁর মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পার হয়ে গেলেও মনে হয়, তিনি আছেন, আমাদের এই দুর্ভাগা জাতির ত্রাণকর্তা হয়ে।আমার মনে হয়, এরকম কথা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আরো মানুষ বললেও, আমার মতো শিশু বয়সে যারা মুক্তিযুদ্ধ অতিক্রম করেছে, বঙ্গবন্ধুকে সাধারণমানুষের আশ্রয়স্থল ভাবতে দেখেছে, তাদের মনে এই বোধটি আরো বেশি গ্রত্থিত। 
একবার আমি আর আমার ভাই দাদির বিছানায় প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম।  তারপর আমাদের মাথায় আসে,, দুজনে মিলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি ছড়া বানাবো। আমি একলাইন বলবো। ভাই এক লাইন বলবে। এভাবেই দু’জনের রফা হলো। তারপর দুজনে বলতে বলতে যখন ফিরে ফিরে বলতে লাগলাম, আমার দাদীর নামাজ পড়া শেষে জমিদারকন্যা আমার দাদি কেঁদে ফেললেন। হতে পারে কারণটা দু’রকম! যে তার দুটি শিশু উত্তরসূরী এমন করে ছড়া কাটতে পারে। আর দ্বিতীয়ত বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানে বন্দী। কত দুঃখকষ্টে তিনি সেখানে আছেন। কি শাস্তি তাঁকে সেখানে দেয়া হচ্ছে এ নিয়ে আমি সেই শিশুচোখে সাধারণ মানুষের ভেতর যে হাহাকার দেখেছি, যে দুশ্চিন্তা দেখেছি, জীবনে সে অভিজ্ঞতাঅবিমিশ্র। কারো সাধ্য নেই তা প্রভাবিত করে। তখনঅমন বিপন্ন জীবন নিয়েও, কোনো অশীতিপর বৃদ্ধ, বা মরণাপন্ন একটি মানুষকেও কোনোদিন এই বলে আমি উষ্মা প্রকাশ করতে দেখিনি, যে জাতিকে মুজিবর দুরবস্থার ভেতর ঠেলে দিয়েছেন, আগে ভালই তো ছিলামৃ!
এখন সবকিছুতে, সব বিশ্বাসে একটা শঙ্কা লুকানো থাকে স্বার্থন্ধতার। এখন ভুল নামে জট পাকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পেয়েছেন, মানে এটা তাঁর অর্জন, মানুষের এই নিঃশর্ত ভালবাসা। ভরসা। তিনি তাঁর বদান্যতায় এগুলো অর্জন করেছিলেন।আমি গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার পশাপাশি নাহলেও কাছাকাছি গ্রাম চন্দ্রদিঘলিয়ায়জন্মেছি। সেই সুবাদে আমাকে পড়া শিখে, বা বড় হয়ে জানতে হয়নি, যে এক শীতের ভেতর একজন লাঙ্গল নিয়ে শীতের অতি ভোরে মাঠে যাচ্ছিল, তার গায়ে শুধু একখানা গামছা জড়ানো দেখে বঙ্গবন্ধু তাকে নিজের গায়ের পশমী শালটা জড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভাই এটা তুমি নাও, বাড়িতে আমার আরো আছে।’

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে প্রায়। সবার মতো আমারাও দৌড়াদৌড়ি করতে করতে বিধস্ত। বাড়ির কাছাকাছি ফুপুর বাড়ি আমাদের। ক’দিন আগে ফুপুর বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সে আগুন অবশ্য রাজাকারের লাগানো নয়। রাজাকাররা সে বাড়ির অন্যান্য ঘরে আগুন দিলেও ফুপুর ঘরখানা সহজে পোড়ানোর মতো ছিল না। তাই সেখানা তখন বেঁচে গিয়েছিল। পরে  সে ঘর কারো অসতর্ক আগুনে পুড়েছিল। তবে তার মাত্র কিছুদিন আগে আমার ফুপাকে কুষ্টিয়ার আলমডাঙ্গা থানায় অনেকের সাথে একসাথে লাইনে দাঁড় করিয়ে মিলিটারিরা মেরে ফেলে। ফুপা ছিলেন আরমডাঙ্গা থানার দারোগা। 
তো পোড়া টিন দিয়ে ছাপড়া বেঁধে ফুপুদের আবার মাথা গোঁজার ঠাঁই হলো। নিজেরা মিলে ঘরের ডোয়া গাঁথার কাজ করতে হয়েছে। আমরা ছোটরা পুকুরের পাড় থেকে ভাতের বোল ভরে কাদামাটি এনে দিতাম। আর বড়রা সেই মাটিতে ডোয়া বা পিড়ি ঠিক করতো। কাজটি করে প্রচুর আনন্দ যেমন পেতাম, তেমনি দুপুরে পেট ভরে খেতে পারতাম। বাড়িতে যা ছিল অনিশ্চিত।
দু’দিন পর ফুপুর বাড়ি থেকে ফিরে এসে দেখি নিরন্ন প্রায় আমাদের ঘর থেকে মাংস রান্নার ঘ্রাণ আসছে। জানলাম, আমার জন্মেরও আগে মায়ের বাবার বাড়ি থেকে দেয়া একটি গাভী মা পাশের গ্রামে পালতে দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনদিন সে পালনকর্তারা আমাদের একটু দুধ বা একটা বাছুর কিছু দেয়নি। আর দেবেই বা কাকে। আমরা তো গ্রামে তেমন একটা থাকতাম না। হুটহাট এসেও গরু-বাছুর-দুধ, কিছুরই খবরও নিতাম না। তো, সেই যুদ্ধের ভেতর আচমকা তারা একটা এঁড়ে নিয়ে এসে অতীত-ভবিষ্যতের স-ব দাবি ছেড়ে দিতে বললো মাকে। যাহোক, আমার মা বঙ্গবন্ধুর নামে সেই গরু জবাই দিয়ে মাংস বিলিয়ে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যেন ভাল থাকেন। ভালভাবে দেশে এসে পৌঁছেন, এই নিয়তে। 
মা-বাবার চেতনার ভেতরই আমার জন্ম। আমার বেড়ে ওঠা! এই পুরো লেখাটি জুড়ে যা বলতে চেয়েছি, আমার আব্বা ছিলেন খুবই ভীতু একজন মানুষ। তিনি যেখানেই থাকতেন, একটি গুলির শব্দ শুনলেও তাড়াতাড়ি সটান হয়ে শুয়ে পড়তেন। সেই তিনিই এলাকার তরুণদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন যুদ্ধে যেতে। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে গোপালগঞ্জের ভেড়ার হাটে, এক হাটের দিন পুরো হাট মিলিটারিরা ঘিরে ফেলে। আর ভেড়ার হাট হচ্ছে নদীর কূলে। আশেপাশের হাটের থেকে ওটা ছিল সবচেয়ে বড় হাট।তার জন্য লোক সমাগম যেমন বেশি হওয়ার কথা। তেমনি একদিকে শহর আরেকদিকে নদী, এমন হাট ঘিরে ফেলা যে কোনো শত্রুর জন্য সহজও। নদীতে লঞ্চ-জাহাজ ভরা সৈন্য। গোলা-বারুদ।  তেমনি এদিকে শহরের রাস্তায় ট্রাক ভরাৃ। 
হাট ঘিরে ফেলার পর কারো আর নড়বার শক্তি থাকলো না। হাজার হাজার মানুষ যে যেখানে ছিল, অনঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। এর ভেতর সবাই ফিসফিসিয়ে আমার আব্বাকে খুঁজতে লাগলেন, ‘জহুরুল হক কই’ বলে। আমার আব্বা ওই হাটেই ছিলেন। তারপর আমার অব্বা জহুরুল হক ভূঁইয়াকে সবাই ধরেবেঁধে একটা টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে দিলেন। আব্বা একসময় পাকিস্তানে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে ইংরেজির মতো ভাল উর্দুও পারতেন। তারপর উর্দুতে বক্তৃতা দিয়ে তাদেরকে, মানে মিলিটারিদেরকে এমন সন্তুষ্ট করে দিলেন, যে শত শত তাক করা বন্দুকের নল নিচে নামাতে বাধ্য হল তারা। অথচ এত বড় একটি বিষয় মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ নিয়ে যেসব বই রচিত হয়েছে, কোথাও কেউ উল্লেখ করেছেন বলে শুনিনি!
দেশ স্বাধীন হলে আবার আমরা এলাম টঙ্গীতে। ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাস থ্রীতে। এসে বসলাম ফোরের ক্লাসে। ভাইটি সেভেনে। দেশে বা টঙ্গীতে কিছুই ছিল না আমাদের। আবার নতুন করে স-ব একটু একটু করে নিতে হলো। কিন্ত সেইরকম দিন আর ফিরে এলো না। ‘সিমোডিন ইউনানী দাওয়াখানা’ নামে আমাদের একটি কারখানা ছিল। যেখানে ভেষজ ঔষধ তৈরি হতো। কিন্তু যুদ্ধে তার রমরমা অবস্থাটা আর ছিল না। কিন্তু এত দুরবস্থার ভেতরও নিজেদেরকে সম্বলহীন মনে হয়েছে, কিন্তু অসহায় মনে হয়নি কখনো। মনে হতো আমাদের আছে বঙ্গবন্ধু, আমাদের আছে স্বাধীনতা। আছে বাংলাদেশ।
পচাত্তরের পনের আগস্ট। আমরা টংগীর সেই বাড়িতে। আব্বা ছুটতে ছুটতে এসে বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছেৃ।’ দু:সংবাদটি চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে গেল আমাদের সব উচ্ছ্বাস! আমরা শিশু দু’টি ভাইবোন আগের মতো আর সেধে কাউকে বলি না, বঙ্গবন্ধুর চাচাতো ভাই শেখ একরামুল হক নান্না মিয়ার স্ত্রী মিসরি বেগম আমার দাদির ছোট বোন।গোপালগঞ্জের মানুষ হিসাবে এমনিতেই আমাদেরও থাকতে হত স্বাধীনতা বিরোধীদের কোপানলে, আর সেই থেকে মনে হয় প্রাণে আর আমাদের প্রাণ ফিরেআসেনি!

0 comments:

Post a Comment