Sunday, July 26, 2020

ট্রানজিস্টার গল্প (মনি হায়দার)



                                                           
                                                                       ট্রানজিস্ট্রার
                                                 মনি হায়দার

শফি তালুকদারের তালুকদারী এখন নেই।
এখন কি, কখনোই তালুকদারী  ছিলো না। নামেই কেবল তালুকদার। অবশ্য দাদা কোরবান তালুকদারের মুখে শুনেছে, কোনো এক কালে নাকি তারা অনেক বড় তালুকদার ছিলো। শত শত বিঘা জমির মালিক ছিলো। বছরের নির্দিষ্ট দিনে প্রজারা খাজনা দিতো।  গোলা ভরা ছিল ধান। এলাকার লোজজন সন্মান করতো।  কোথায় সে সব তালুকদারী হারিয়ে গেছে, জানে না শফি তালুকদার। জন্ম থেকেই দেখেছে টেনে টুনে জীবন। বাবা দয়াল তালুকদার হালচাল করে সংসার চালাচ্ছে। বাড়ির কাছে বোথলা হাই স্কৃুল থেকে মেট্রিকটা পাশ করলেও বাবার সঙ্গে ক্ষেতে খামারে কাজ করেছে। সেই কাজ এখনও সে করছে। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে সকালের দিকে শফি তালুকদারের বোথলা বাজারে আসা চাই, কেবল জাকিরের দোকানের এক কাপ চা খাওয়ার জন্য। আজও চা খাচ্ছিল সে, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তাকায় সাদাকালো টিভির দিকে। নীচের ক্রলে নানা সংবাদ একের পর এক  ভেসে উঠছে। হঠাৎ একটা সংবাদে চোখ আটকে যায় শফি তালুকাদের, আগামীকাল...। 
সঙ্গে সঙ্গে শফি তালুকদারের বুকের মধ্যে অনেক অনেক দিন ঘুমিয়ে থাকা একটা সিংহ বিকট শব্দে জেগে ওঠে।  শব্দটা তাকে কাঁপিয়ে দিলেও সেই শব্দটা কেবল শফিই শুনতে পায়। দ্রুত চা খেয়ে জাকিরকে টাকা দিয়ে হন হন করে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে। বোথলা বাজার থেকে বাড়ির দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। এক প্রকার দৌড়ে বাড়িতে এসে হাপাতে হাপাতে স্ত্রী হালিমাকে ডাকে, এই এদিকে আসো।
হালিমা গরুর গোয়াল থেকে বের হয়ে সামনে দাঁড়ায়, কি অইচে আপনের? 
কয়েক মুহূর্ত স্ত্রী হালিমার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে, আমাগো রেডিওটা কই?
রেডিও? হালিমা হাতের আগল নিচে নামিয়ে রেখে তীক্ষ্নচোখে স্বামীর দিকে তাকায়, কিয়ের রেডিও কতা কইতেছেন আপনে?
আমাগো বাড়িতে একটা রেডিও ছিলো না? আমরা হারাদিন গান বাজনা হুনতামÑ
হালিমা বেগম অবাক চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবে, মানুষটা কি কোনোদিন মানুষ হবে না? সেই একুশ বাইশ বছর আগের রেডিও কি এখনও আছে? আর রেডিওতো এই মানুষটাই বন্ধ করে দিয়েছিল। বলেছিল, আমার ঘরে আর রেডিও বাজবে না। 
সারাদিন রাত, যতক্ষণ যন্ত্রটার ভেতরে গান আর অনুষ্ঠান হতো খোলাই থাকতো। হাঁটতে বসতে কাজ করতে করতে কতো নাটক শুনেছে। আরও শুনেছে দেশের শিল্পী সাহিত্যিক রাজনৈতিক নেতাদের সাক্ষাৎকার । কেবল কি ঘরের মানুষে শুনেছে? আশপাশের দুই চার বাড়ির মানুষও শুনেছে। রেডিওটাতো খায়েরের বাবাই কিনে এনেছিল মুক্তিযুদ্ধ থেকে আসার পর। বাড়ির সবাই আন›ন্দে উচ্ছাসে মেতে উঠেছিল।  সবাই টানাটানি করলে খায়েরের বাপ বলেছিল, তোমরা যা ইচ্ছা হোনো,  আমি হুনবো শেখ মুজিবরকে। 
সেই সময়ে রেডিওতে প্রায়ই শেখ মুজিবের কণ্ঠ শোনা যেতো, সন্ধ্যার দিকে। হারাদিন কাম কাইজের পর সন্ধ্যা হলে মানুষটা রেডিওটা নিয়ে ঘরের বড় চৌকিতে শুয়ে থাকতো। রেডিও শুনতে শুনতে রাতের ভাত খেয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে যেতো। 
সকালে উঠে কাজে চলে গেলে, আর সারাদিনে রেডিওটার খবর থাকতো না। একবার পাশের বাড়ির  জয়তুনের মায়ের পায়ে ধাক্কা লেগে রেডিওটা বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যায় বাড়ি এসে খায়েরের বাবা শফি তালুকদার নব ঘুরায় রেডিওর, চড় চড় শব্দ হয় কিন্তু কথা শোনা যায় না। যে মানুষটা কথা বলে না প্রায়ই কারো সঙ্গে, থাকে চুপচাপ, সেই মানুষটা রাগে কেঁেপ উঠলো, রেডিও কতা কয় না ক্যা?
ভয়ে ভয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় হালিমা, ওটাতো যন্ত্রর। যন্ত্রর নষ্ট অইতে পারে না? হারাদিনইতো বাজে
বাজান! ছয় বছরের খায়ের গলা বাড়ায়, ওই বাড়ির জয়তুনের মায়ে পা দিয়া লাড়া দিছে। 
শফি ভাটার চোখ নিয়ে তাকায় স্ত্রী হালিমার দিকে, তুমি আমারে ছাগল পাইছো? আর ওই খাটাইসা বিডি আইছিল ক্যা? আইছে, হেয় আইছে আমার রেডিওতে ধাক্কা দিল ক্যা?
আরে হোনেন, রেডিওতো ছিল মাটির উপর, রান্না ঘরে। হে আইচে রোদ চোহে লইয়া, খেয়াল হরে নাই। আর তেমন বেশিতো ধাক্কা লাগে নাই। 
আইজ আর আমার ঘুম অইবে নাÑশফি তালুকদার রেডিওটা বিছানার এক পাশে ধাক্কা দিয়ে রাখতে রাখতে বলে। এহন আমি কি হুনমু? কি করুম?
হালিমার ঠোটে বিপন্ন হাসি, একরাইত রেডিও না হোনলে আপনের ঘুম অইবে না?
তুই বুঝবি না। রেডিওডারে আমি শ্যাক মুজিব মনে করি। জীবনেতো হের কাছে যাইতে পারি নাই,  কেবল কতা হনুছি। রেডিওর সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে হেয় কতো কতা কয়, আমি হুনি আর হেরে ভাবি। হেয় কতোবড় নেতা তুই পাইলা মাইঝা বুঝবি কেমনে? 
আমার বোঝনের কাম নাই আমার রান্দন ঘরে অনেক কাম পইরা রাইচে, হালিমা রান্না ঘরে চলে যায়। শফি তালুকদার একটা কাঁথা টেনে মুখের উপর এনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। অন্ধকার রাত। আকাশে তারার ঝিকিমিকি। মনে পড়ে- এই তো মাত্র তিন বছর আগের ঘটনা। 
বোথলা গ্রামটা একেবারে গ্রামই। শহরের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম রেডিও বা ট্রানজিস্টার। গ্রামের সকল মানুষ কৃষিজীবী। নিস্তরঙ্গ। কোনো উত্তেজনা নাই। হঠাৎ একদিন শোনা গেলো, এই দেশে, যুদ্ধ শুরু অইচে। কোথায়? ঢাকা শহরে। দুই একজন মানুষ, যারা ঢাকা শহরে ছিল, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পনেরো বিশদিন পরে গ্রামে এসে যে বিবরণ দিয়েছে, শুনে অবাক। গ্রামের মানুষ মানতে পারছে না, একই দেশের মানুষ অইয়া এইভাবে মানুষ মারতে পারে? আবার কয়েকদিন পরে শোনা গেলো- দেশে রাজাকার বাহিনী হয়েছে। লোকজনের মুখে কোনো কথা নেই। সবাই যে কোনো ঘটনার জন্য প্রস্তুত। 
ঘটনার আগে যে ভোট হয়েছিল, গ্রামের মানুষ একজোট হয়ে শেখ মুজিবের নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিল। সেই ভোটে অংশ নিয়েছিল শফি তালুকদারও। শফি তালুকদার খুব নির্বিরোধি মানুষ। কারো সঙ্গে ঝগড়া করেছে, গ্রামের কেউ বলতে পারবে না। পাশের গ্রাম উজানগাওয়ের চেতন মাঝির কথাবার্তা খুব ভালা লাগতো শফি তালুকদারের। চেতন মাঝি লেখাপড়া জানা মানুষ। কয়েকবার ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও ছিল। সেই চেতন মাঝি নৌকার ভোটের সময়ে বোথলা বাজারে মাইক নিয়ে শেখ মুজিব, ছয় দফা, পাকিস্তানের মধ্যে ফাকিস্তানের অনেক ঘটনা বলতে শুরু করলে, তরকারি বিক্রি বন্ধ রেখে শফি তালুকদার গোগ্রাসে শুনেছিল। শুনে বুঝতে পেরেছিল, শেখ মুজিবের নৌকায় উঠতে হবে। ফলে, শফি তালুকদার চেতন মাঝির সঙ্গে যোগ দিয়ে নৌকার ক্যনভাসে নামে। আর যেদিন রেডিওতে শেখ মুজিব নির্বাচর্নী ভাষণ দিয়েছিলেন, সেদিনই প্রথম চেতন মাঝির উঠোনে বসে গলা শুনে মনে হয়েছিল, এমন সাহসী আর দরদী গলার মানুষটা খুব আপন। এমন করে দেশের মানুষের জন্য কেউ কথা বলেনি। 
নির্বাচনের পর  গ্রামে আবার সব কিছু চুপচাপ। কিন্ত এখন একি শোনা যাচ্ছে? পাশ্চিম পাকিস্তানীরা আক্রমন করছে নিজেদের দেশ? চেতন মাঝি বললো, যুদ্ধ করতে হবে। মাস খানেকের মধ্যে এলাকায় একটা মুক্তিযোদ্ধাদের দল গড়ে ওঠে। চেতন মাঝির এক মামাতো ভাই, ইকবাল মিয়া পুলিশে চাকরি করতো, এখন বাড়িতে। সে এসে ট্রেনিং দিতে আরম্ব করে স্কুলের মাঠে। শফি তালুকাদার ভিড়ে যায় দলে। আট মাসের মধ্যে শফি একদিনের জন্যে বাড়ি আসে নাই। অনেক জায়গায় যুদ্ধ করেছে, সুন্দরবনে গেছে, কচা নদীতে যুদ্ধ করে গানবোট ডুবিয়ে দিয়েছে। সেই সময়ে থেকেই শফির একমাত্র সঙ্গী হয়ে উঠেছিল, একটা দুই ব্যান্ডের ট্রানজিস্টার। স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রথম শোনে সাতই মার্চের ভাষণ, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আরও শোনে,  আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের উপর হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে...। 
যুদ্ধ করতে করতে দেশটা হঠাৎ স্বাধীন হয়ে গেলো। চেতন মাঝির কাছে থ্রি নট থ্রি রাইফেলটা দিয়ে ট্রানজিস্টারটা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে শফি। কোনো চাহিদা নেই। কোনো দাবী নেই। স্বাভাবিক জীবন শুরু করে। তবে গ্রামের মানুষ অবাক হয়েছিল নির্বিরোধি গোবেচারা টাইপের মানুষ শফি তালুকদারও যুদ্ধে গিয়েছিল জেনে! 
আবার জমি চাষ, বাজারে তরিতরকারি বিক্রি করে সংসার যাত্রা চালানো। আর রাতে রেডিওতে শোনে, শেখ মুজিবের খবর। দেশে বিদেশে যায় নেতা, দেশের উন্নতির জন্য কাজ করছে, মানুষদের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন, শফি তালুকদার ট্রানজিস্টার বুকের কাছে নিয়ে শোনে। শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে উঠে রেডিওটা ছেড়ে আবার স্বাভাবিক কাজে লেগে  যায়। এক সকালে সেই  রেডিও থেকে শুনতে পায়, আমি মেজর ডালিম বলছি.. শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছে...। 
পাথরের মতো স্তব্দ হয়ে যায় শফি তালুকদার। মনে হলো, বুকের গভীর গোপন থেকে কেউ একজন এক খাবলায় কলিজাটা উপরে নিয়েছে। মানুষটা একেবারে বোবা হয়ে যায়। মনে হলো, রেডিওটা মিথ্যা বলছে। যন্ত্রটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শফি তালুকদার ট্রানজিস্টারটার নব টিপে বন্ধ করে জানিয়ে দেয়, এই ঘরে আর রেডিও বাজবে না। 
হালিমার যদিও খারাপ লাগছিল কিন্তু স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে, স্বামীর শোক ও বেদনাকে অনুভব করে ট্রানজিস্টারটাকে উপরে মাচায় উঠিয়ে রাখে। সেই ট্রানজিস্টার আর কেউ কোনোদিন চালায়নি। এক সময়ে বাতিল জিনিষের সঙ্গে একটা পুরানা বাক্সে ভরে রেখে দিয়েছিল পিছনের বারান্দায়। সে কতো বছর আগের ঘটনা? এখন এই পাগল মানুষকে কি বলবে হালিমা?
কতা কও না ক্যা? শফি তালুকদার স্ত্রী হালিমার চোখের উপর চোখ রাখে। তুমিইতো রাখচো। কোতায় রাকচো?
হেই রেডিও কি আছে?
আছে নাতো কি? ভাইজা খাইচো?
রেডিও কি ভাইজা খাওনের জিনিশ?
চেতে যায় শফি তালুকদার, এতো কতা কও ক্যা? রেডিওটা কোতায়?
বারিন্দায়, বড় টিনের বাক্সটার মইধ্যে রাকছি কবে! এহনও কি আছে? ইন্দুরে কাইটা রাখছে কিছু?
শফি তালুকদার এই দৌড়ে বারান্দায় যায়। অনেক  ময়লা, ছেঁড়া কাঁথার স্তূপের ভেতর থেকে টেনে টিনের বাক্সটা বের করে সামনে আনে। বা´টার উপরের ঢালা জং ধরে ক্ষয়ে গেছে। ভেতরে তেলাপোকা আর ইঁদুরের বিষ্টার বিকৃত গন্ধ। নাক চেপে টেনে বাক্সটা বাইরে এনে ফেললে, বাক্সটা চারিদিকে খুলে পড়ে। শফি দ্রুত হাতে ভেতরের সব বের করে আনতে আনতে ট্রানজিস্টারটা পেয়ে যায়। কিন্তু অবস্থা খুবইা খারাপ। ট্রানজিস্টারের পেছনের মাইকের ঢাকনা ক্ষয়ে ক্ষয়ে একেবারে জীর্ণ। ধরার সঙ্গে সঙ্গে খুলে হাতে আসে তালুকদারের। ব্যাটারি পচে শুকিয়ে আমচুর হয়ে আছে। হালিমা এসে অবাক চোখে শফির  কাজ দেখে আপনে এইডা দিয়া কি করবেন?
হালিমার দিকে এক পলক তাকিয়ে, পরনের লুঙ্গি দিয়ে ট্রানজিস্টারকে মুছতে থাকে। মুছতে মুছতে ময়লা, দাগ কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে। খুব যত্ন করে ট্রানজিস্টারটাকে বুকের কাছে নিয়ে ঘরে ঢোকে। পিছনে পিছনে হালিমা। ট্রানজিস্টারটাকে খাটের উপর রাখলে ছয় বছরের নাতনী কাকলী জিজ্ঞেস করে, দাদা এইডা কি?
কিছু না। ধরবা না তুমি। তাকায় হালিমার দিকে, খাওন আছে? আমারে খাইতে দাও। আমি গোছল কইরা আইতেছি। হাতে আর একটা লুঙ্গি নিয়ে শফি তালুকদার দৌড়ায় পুকুরঘাটের দিকে। হালিমার দেয়া খাবার খেয়ে ট্রানজিস্টারটা একটা কাপড়ের ব্যাগে ভরে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। দ্রত হেঁটে বোথলা বাজারে এসে একটা বাসে উঠে উপজেলা ভানডারিয়ায় নামে দুপরের সময়ে। খুঁজে বের করে টেলিভিশন মেরামতের দোকান। কেরামত মাইক সার্ভিসের দোকানের ভেতরে বসে আছে কেরামত আলী। আজকাল মাইকও তেমন চলে না। ঘরে ঘরে টিভি। ট্রানজিস্টারতো শোনা বাদ দিয়েছে আরও দশ বছর আগে। দোকানের দশাও  ফকিরি। মাঝে মধ্যে দু একটা টিভি সারাতে আসে কেরামত আলীর কাছে। গত কয়েক বছরে কেরামত রেডিও টিভি বাদ দিয়ে ফ্রিজের কাজ করছে। কোনো রকমে টিকে আছে আর কি! 
শফি তালুকদারকে দেখে তাকায় কেরামত আলী, কি ভাই?
আমার একটা কাম কইরা দিতে পারবেন?
কি কাম? 
শফি তালুকদার খুব যত্নের সঙ্গে কাপড়ের ব্যাগের ভেতর দিয়ে  ট্রানজিস্টারটা বের করে সামনের টেবিলের উপর রাখে। কেরামত মিস্ত্রী অবিশা¦স্য চোখে ট্রনাজিস্টারের দিকে তাকিয়ে একবার দেখে তাকায় শফি তালুকদারের দিকে। শফি তালুকদার অসহয় চোখে তাকিয়ে থাকে মিস্ত্রীর কোটরাগত গোলাটে চোখের ফ্যাকাসে মণির উপর। মনে হচ্ছে, ভীষণ কোনো অন্যায় করে কেরামত মিস্ত্রীর হাতে ধরা খেয়েছে। 
এইডা আনছেন ক্যান?
ঠিক কইরা দেনÑ
অবিশ^াস্য কণ্ঠে উত্তর দেয় কেরামত মিস্ত্রী, এই জিনিষ ঠিক করাবেন? আপনে কি পাগল অইছেন? 
খপ করে হাত ধরে শফি তালুকদার, আপনে টাকা পয়সা লইয়া চিন্তা কইরেন না। আপনি অনেক পুরানা দিনের মানুষ, আপনে পারবেন।
কেরামত মিস্ত্রী পেছনের ডাকনাটা খুলে ট্রানজিস্টারের ভেতর যন্ত্র, যন্তাংশ নাড়াচাড়া করতে করতে করতে বলে, বড় অসম্ভব একটা কাম লইয়া আইচেন ভাই।  
দয়া করে একটু চেষ্টা করেনÑ শফি তালুকদারের গলায় মিনতি । 
ঠিক আছে, তিনশো টাকা রাইখা যান। তিন পরে আসেন, দেখি কি করতে পারি।
আবারও হাত ধরে শফি তালুকদার, মিস্ত্রী সাব, আমার আইজ দিনের মইধ্যে রেডিওটা দেতে অইবে। 
কন কি আপনে?
হয়, আইজই দেতে অইবে। আমি আপনেরে পাচশো টাহা দিমু। 
কেরামত মিস্ত্রী অভিজ্ঞতা কম না। জীবনে  এই প্রকারের অনেক পাগলের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। এখন বুড়ো বয়সে আর একজন পাগলের দেখা পাওয়া গেলো। খুব তীক্ষè চোখে ট্রানজিস্টারের ভেতরটা ড্রাইভার দিয়ে দেখে, বুঝতে পারে, ঠিক করতে পারবে। 
তাকায় শফি তালুকদারের দিকে, আপনে বসেন। দেখি আমি কি করতে পারি। তয়, আগেই কইয়া রাখলামÑ আমি সাধ্যমত চেষ্টা করমু। যদি না পারি, আমারে কিন্তু টাকা দিতে অইবে। 
সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝাকায় শফি তালুকদার, আপনে চিন্তা কইরেন না, দিমু। 
দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার সকল সুই সুতো নিয়ে বসে কেরামত মাইক সার্ভিসের অভিজ্ঞ কেরামত আলী, শফি তালুকদারের ততোদিক পুরানো পরিত্যক্ত, পোক্য়া খাওয়া, ইদুরে কাটা ট্রানজিস্টার নিয়ে। সারাদিনের পরিশ্রম আর মেধার কারুকাজে সন্ধ্যার আগে আগে ট্রানজিস্টারটা ঠিক করে দেয় কেরামত মিস্ত্রী। একটি মুহুর্তের জন্য কেরামতের দোকান থেকে বাইরে যায়নি শফি তালুকদার। তার অনুপস্থিতিতে যদি অন্য কেউ টিভি বা ফ্রিজ নিয়ে আসে, তাহলে তার ট্রানজিস্টার মেরামতের কাজ ফেলে রেখে সেই কাজ করবে। তালুকতার কোনো সুযোগ দিতেই চায়নি কেরামত মিস্ত্রীকে। নতুন ব্যাটারি কিনে, ট্রানজিসাটরের ভেতরে বসিয়ে, কয়েক মিনিট অনুষ্ঠান শুনে একাত্তরের যুদ্ধ জয়ের আনন্দে কাপড়ের ব্যাগে ভরে বোথলার দিতে যাত্রা করে শফি তালুকাদার। 
রাত ন’টার দিকে বাড়ি ফিরে, খেয়ে শুয়ে পরে। বিছানায়, মাথার কাছে ট্রানজিস্টার। হালিমার ভেতরে এক ধরনের স্মৃতি সুখ বাঘে তাড়া খাওয়া হরিণের গতিতে  হানা দেয়। কতো মজার মজা গান, কৌতুক, নাটক শুনেছে এই রেডিওতে। এতো বছর পর সেই রেডিও আবার বাজবে!
একটু বাজান নাÑ আবদার করে হালিমা। 
আইজ না। কাইল বাজামু, নির্লিপ্ত উত্তর দেয় স্বামী শফি তালুকদার। 
ক্যা.এহন বাজাইলে কি অইবে? একটু বাজান। কতোদিন হুনি না গান।
শফি তালুকদার উল্টোদিকে ফিরে শুয়ে ট্রানজিস্টারটাকে বুকের সঙ্গে রাখে। হালিমার বেগমের মধ্যে এক ধরনের ক্রোধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, মানুষটা সারা জীবন কথা কইলো কম, আর যা একবার মনে লাগে করেই ছাড়ে। এই রাতে পাশাপাশি শুয়ে সেই পুরোনো দিনর মতো রেডিও শুনলে কি হয়? স্বামীর সঙ্গে রাগ করে সেও, বিপরীত দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে যায়। 

খুব ভোরে হালিমার ঘুম ভাঙ্গে পবিত্র কোরআন পাঠের শব্দে। মাথার কাছে ট্রানজিস্টার থেকে পবিত্র সুর ভেসে আসছে। শফি নিমগ্ন মনে ট্রানজিস্টারের সামনে নিবিষ্ট মনে উবু হয়ে বসে আছে। শুনবে এই ট্রানজিস্টার থেকেই প্রচারিত সংবাদে শেখ মুজিবের হত্যাকারিদের বিচারের রায়....। 

0 comments:

Post a Comment