Tuesday, July 28, 2020

ভ্রূণ , গল্প (অসীম সাহা)


ভ্রূণ
অসীম সাহা

সাদা জ্যোৎস্না নেমেছে বিলে। চারদিকে ঘন কুয়াশা ঝরাচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদ। দক্ষিণের দরজা-জানালা খুলে একটু হাওয়া ছুটে আসছে আলতোভাবে। জল প্রায় নিস্তরঙ্গ, হাওয়ার মৃদু স্পর্শে শিরশির করে উঠছে তার গা। এদিকে-সেদিকে শ্যাওলা আর ভেজা খড় মাথা তুলে নিশ্বাস টানছে। দূর থেকে ভালো মতো নজরে আসে না। আনমনে ঝিঁঝি ডাকে। অসীম শূন্যতা সমস্ত চরাচরে হাহা করতে থাকে।
মাঝখানে শব্দ জাগে ছপছপ। তিনটি নৌকা দাঁড় টানে মন্থর গতিতে। মাঝখানের নৌকাটা তীরের ফলার মতো সামান্য এগিয়ে আছে। যেন আর দুটো নৌকা গার্ড অব অনার দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। গলুইয়ের সামনে তিন স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান। দুটি চোখ সতর্ক পাহরা দিচ্ছে। নির্বাক স্ট্যাচুর মতো স্থির। নিঃশ্বদ সময়টা হরিণের মতো লঘু পায়ে হেঁটে চলে যায়। ছইয়ের ভেতরে কয়েকজন ঘুমে। কেউ কেউ জেগে আছে। তাদের কথাবার্তার চাপা ফিসফাস আওয়াজ বেশি দূর পর্যন্ত যেতে পারে না। মাঝের নৌকায় জাহাঙ্গীর। রাত প্রায় শেষ। কেমন একটা শীতল আমেজ তাকে ঘিরে ধরেছে। এ সময়ে ডিউটি পড়েছে তার। অন্য দুইটাতে মনোয়ার ও সাঈদ। কেউ কারও দিকে চোখ ফেরায় না। ব্যাপারটা আগে চোখে পড়ল জাহাঙ্গীরের। দূরে ভূতের মতো একটা অনড়, অস্পষ্ট ছায়া। এখান থেকে জায়গাটাকে বেশ উঁচু মনে হয়। জাহাঙ্গীর আস্তে ডাকে, ‘মনোয়ার।’
মনোয়ার না তাকিয়েই উত্তর দেয়, ‘বল।’
‘সামনে দেখেছিস?’
‘কী?’
‘মনে হয়, কেউ যেন পাহারা দিচ্ছে।’
মনোয়ার ও সাঈদ দুজনেই সামনের দিকে সতর্কভাবে দৃষ্টি ছুড়ে দেয়। ছায়াটা ওদেরও নজরে আসে। জাহাঙ্গীর জিজ্ঞেস করে, ‘দেখেছিস?’
‘হু’
‘কী মনে হয়?’
‘আমার কী মনে হয় জানিস?’ সাঈদ উত্তর দেয়।
‘কী?’
‘কোনো গাছের ছায়াটায়া হবে।’
মনোয়ার বলে, ‘আরে না না। একটা লোক, বোঝা-ই যাচ্ছে। আমার তো মনে হয়, কাঁধে একটা রাইফেলও আছে।’
মনোয়ারের কথায় জাহাঙ্গীর ও সাঈদ ভালো করে তাকায়। এবার তাদের চোখেও অস্পষ্ট রাইফেল ভাসে। ওরা নিশ্চিন্ত হয়ে যায়, সামনে কেউ পাহারা দিচ্ছে। কে লোকটা, মুক্তিযোদ্ধা, না রাজাকার? কিছুই বোঝবার উপায় নেই। সামনে এগিয়ে যাবে না এখানেই হল্ট করবে, বুঝে উঠতে পারে না ওরা। এই পথে আগে আর কখনো আসেনি। ট্রেনিং শেষ করে ভেতরে ঢুকছে। যাবে মানিকগঞ্জ। ওরা জানে, পথে পথে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি আছে। আবার কোথাও কোথাও রাজাকাররাও ঘাপটি মেরে আছে। ওরা তাই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সবাইকে জানানো দরকার। প্রস্তুতি নেয়া দরকার। মুক্তিযোদ্ধা হলে ভালো, রাজাকার হলে এমনিতে ছাড়া যাবে না। সামনে এগানোর আগেই রেডি হওয়া ভালো। জাহাঙ্গীর সবাইকে ডাকল। ভেতরে যারা ঘুমে, আধোঘুমে ছিল, লাফিয়ে উঠল। জরুরি প্রয়োজন না পড়লে সাধারণত কেউ কাউকে ডাকে না, ডাকার দরকারও হয় না। জাহাঙ্গীরের কণ্ঠ শুনেই ওরা বুঝতে পারে, এই ডাক এমনিতেই আসেনি। সবাই প্রায় একসাথে বাইরে বেরিয়ে আসে। ওরা বিশ জন। সামনে তাকিয়ে পাহারারত সেই লোকটাকে দেখে। ইতিমধ্যে নৌকাটা আরও একটু কাছে এগিয়ে আসায় লোকটা একটু স্পষ্ট হয়। সবাই ঝটপট রেডি হয়ে নেয়। জাহাঙ্গীর এই গ্রুপের কমান্ডার। তা হলেও বন্ধুর মতো। একমাত্র অ্যাকশনের সময় জাহাঙ্গীর বলল, ‘ভয় কী, আমাদের সাথে যে অস্ত্র আছে, তাতে বিশ-ত্রিশ জনকে অনায়াসে উড়িয়ে দেয়া যাবে, কী বলো।’
মনোয়ার বলল, ‘সে তো বটেই। তবে দোস্ত, আগে কনফার্ম হয়ে নাও। তারপর যা হোক হাওয়াই বাজি উড়িও।’
সবাই হেসে ওঠে। মিলিত হাসির চাপা আওয়াজ গমগম করে বেজে ওঠে। জাহাঙ্গীর বরে, ‘তা তো বটেই, আগে কনফার্ম হয়েই নেব। তাহলে এবার তোমরা পজিশন নিয়ে নাও।’
নৌকা তখন অনেক কাছাকাছি এসে পড়েছে। এবার ওরা স্পষ্ট দেখে, একজন লোক উঁচু পুলের ওপর রাইফেল কাঁধে পাহারা দিচ্ছে। তার মুখ ওদের দিকেই ফেরানো। জাহাঙ্গীরের একবার মনে হলো, গুলি চালাবে। ফের মনে হলো, যদি মুক্তিযোদ্ধা হয়! নিশ্চিত না হয়ে গুলি চালানো যায় না। তা ছাড়া এখানে একা একা পাহারা দিলেও সে নিশ্চয়ই একা নয়; আশপাশে আরও কেউ-না-কেউ আছে। জাহাঙ্গীর দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেল। শুধু বলল ‘মাঝি, আস্তে চালাও।’
মনোয়ার ও সাঈদের দিকে তাকাল জাহাঙ্গীর। ওরা মাথা নাড়ল। ভাবভানা এমন, এগোও, যা হয় হবে। তবু জাহাঙ্গীর ভাবলÑতারপর নৌকা পাড়ে লাগানোর নির্দেশ দিল। সবাই রেডি হয়ে বসে আছে মুখোমুখি সংঘর্ষের জন্যে। প্রস্তুতির উত্তেজনা সবাইকে অদ্ভুত সাহসী করে তুলল। লোকটা পুলের ওপর থেকে সবই দেখে। অথচ তার কোনো ভাবন্তর হলো বলে মনে হয় না। স্ট্যাচু নাকি? ভাবে জাহাঙ্গীর। নৌকা পাড় স্পর্শ করার সাথে সাথে সবাই লাফিয়ে নামে। জাহাঙ্গীর, সাঈদ ও মনোয়ার এগিয়ে যায় লোকটার সামনে। অন্য সবাই পজিশননিয়ে নেয়। জাহাঙ্গীর লোকটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। বয়স কত হবে? বেশি হলে তিরিশ। তামাটে রং। গাল ভাঙা, চোখ অনেক ভেতরে। সারা অবয়বে নির্মম এক ক্রূরতা চোখ এড়ায় না জাহাঙ্গীরের। জিজ্ঞেস করে, ‘কে তুমি?’
লোকটা অদ্ভুত চোখে একবার জাহাঙ্গীরের দিকে তাকায়। সেই চোখে ক্রোধ, ঘৃণা না ভালোবাসা কিছুই বোঝা যায় না। অবাক না হয়ে পারে না জাহাঙ্গীর। পৃথিবীতে এমন ধরনের মানুষ আছে, যাদের চোখ কোনো রহস্যের উন্মোচন করতে পারে না। অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না জাহাঙ্গীর। মনোয়ার ও সাঈদের চোখেও বিস্ময় ঝুলে ছিল অনেকক্ষণ। ওরাও তাকিয়ে দেখছিল লোকটাকে। জাহাঙ্গীর একটু রূঢ় কণ্ঠেই বলল, ‘বলো, কে তুমি?’
লোকটা জাহাঙ্গীর দিকে না তাকিয়ে উত্তর দেয়, ‘তা দিয়ে তোমার কী দরকার?’
খটখটে কণ্ঠস্বর। কানে এসে লাগে। মনোয়ার ও সাঈদ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ব্যাটা বলে কী! এক ঘুষিতে চোয়ালটাকে খসিয়ে দেব নাকি! জাহাঙ্গীর থামাল ওদের। লোকটাকে একটু ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘আমরা জানতে চাই, তুমি কে?’
লোকটার কণ্ঠস্বর আগের মতোই খটখটে, ‘আমার পরিচয় জানার দরকার নেই।’
কথা শুনলেই গা জ্বলে যায়। জাহাঙ্গীর ওর হাতে চেপে ধরে টানতে টানতে নৌকার দিকে নিয়ে যায়।
‘চলো, আমাদের জানার দরজার আছে কি নেই, দেখাচ্ছি।’ পুলের নিচে কুমোরদের যে নৌকাটা বাঁধা ছিল, সাঈদ আর মনোয়ার সেদিকে এগিয়ে গেল। 
‘তোমরা এখানে কী করছ?’
নৌকা থেকে একজন উত্তর দিল, ‘কিছু না স্যার, ঐ লোকটা আমাগো আটকাইয়া রাখছে।’
‘কেন?’
‘চান্দা চায়।’
‘কিসের চান্দা?’
‘তা তো জানি না।’
‘ঠিক আছে, তোমরা যাও।’
নৌকাটা বাঁধন ছেড়ে এগিয়ে যায়। সাঈদ, মনোয়ার ও অন্য সকলে নিজেদের নৌকায় ওঠে। নৌকা ছেড়ে দেয়। লোকটা শুধু একবার বলে, ‘কাজটা ভালো করলে না কিন্তু।’
সাঈদ পেছন থেকে ওর পাছায় একটা লাথি মারে।
‘ব্যাটা ভয় দেখাচ্ছে।’
‘গায়ে হাত দিয়ো না। ক্যাম্পে নিয়ে যা করার করা যাবে।’
পুল পার হয়ে জল কেটে তরতর করে এগোতে থাকে নৌকা। কুমোরদের নৌকাটা অনেকটা দূরে চলে গেছে। পেছন থেকে স্তূপাকার হাঁড়িপাতিল নজরে পড়ে। ভোর ভোর হয়ে এসেছে। কেমন একটা আবেশ-করা আমেজ সারা বিলটাকে ঘিরে রেখেছে। চারদিকে শুধু জল আর জল। এখন হাওয়া নেই। ঠাণ্ডা আছে। চাঁদ নেই, আচ্ছান্ন আলো আছে। এরই মধ্য দিয়ে নৌকাটা আস্তে আস্তে এগোতে লাগল। শুধু সেই তরল নিঃসঙ্গতার মধ্যে বৈঠার এক ছন্দোময় ছপছপ আওয়াজ কাঁপতে লাগল থরথর করে।
ছইয়ের নিচে লোকটা নির্বিকার বসে আছে। সবাই তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে। শুধু জাহাঙ্গীর তীক্ষè চোখে দেখে। লোকটার চোখে মুখে, সারা শরীরে একজন অস্বাভাবিক মানুষেল কঙ্কাল লেগে আছে। তার পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি। কাঁধের রাইফেলটি একজন আগেই কেড়ে নিয়েছে। লোকটা কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। তবে মুখে ভয় বা শঙ্কার চিহ্ন বোঝা যায় না। পাগল নাকি? না হলে এমন নির্বিকার বসে আছে কী করে? সে জানে না, তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবেÑ সে বাঁচবে কি মরবে, তা-ও সে জানে না, তবু এমন নির্বিকার বসে থাকা একমাত্র পাগল ছাড়া অন্য কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। জাহাঙ্গীর ভাবতে ভাবতে তল খুঁজে পেল না। লোকটা নিশ্চয়ই রাজাকার নয়। রাজাকারের এত সাহস থাকতে পারে না। মুক্তিবাহিনীও সে নয়। তা হলে সে কী? সে কি কোনো গুপ্ত রাজনৈতিক দলের কর্মী? হতে পারে। জাহাঙ্গীর মোটামুটি সিওর হয়ে যায়। কিন্তু রাজনৈতিক দলের লোক এত নির্বোধ হয়, এটা ভাবতেই কেমন লাগে। লোকটা তার পরিচয় দিলে কী এমন ক্ষতি হতো। বরং ওর জন্যে সেটা ভালোই হতো। অথচ কেমন বাহাদুরি দেখাচ্ছে। কিন্তু লোকটা পুলে পাহারা দিচ্ছিল কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের খতম করার জন্যে, নাকি পয়সা উপার্জন করাই উদ্দেশ্য? বুঝতে পারল না জাহাঙ্গীর। বরং নিজের ভেতরে অসহায়তা বোধ করল সে। প্রশ্ন করল ফের লোকটাকে। জানতে চাইল ওর পরিচয়। লোকটা কথা বলল না। জাহাঙ্গীরের জেদ চেপে গেল। প্রায় ধমকের সুরে বলল, ‘বলো, কেন পাহারা দিচ্ছিলে, কেন?’
তবুও কথা বলল না সে। সাঈদ এসে মৃদু ধাক্কা মেরে বলল, ‘কথা না বললে মেরে বিলের পানিতে ভাসিয়ে দেব।’
লোকটা এবার মৃদু হাসল। খটখটে। তার ঐ হাসিতে কী ছিল কে জানে, সাঈদ অনেকটা চুপসে যায়। নৌকায় যারা ছিল তাদের চোখে বিস্ময় ফুটে ওঠে। লোকটা কি জাদু জানে? কেমন নির্বিকার হাসল। জাহাঙ্গীর ভাবে, লোকটাকে যদি মেরে বিলের পানিতে ভাসিয়ে দিই, তবে সত্যি সত্যিই তা কেউ টের পাবে না। তার পরও এরকম হাসছে লোকটা!
মনোয়ারের একবার মনে হলো, এক গুলিতে থেঁতলে দেয়। পারল না। সবাই ধারণা করল, মাথায় নির্ঘাত গোলমাল আছে। এ নিয়ে বেশ হাসিঠাট্টাও চলে। জাহাঙ্গীর অন্যমনস্কভাবে সামনের দিকে তাকায়। সকালের আলো ফুটছে। পুব আকাশের জানালা দিয়ে সূর্য উঁকি মারছে। চারদিক স্পষ্ট চোখে পড়ে। জাহাঙ্গীর দেখে, একটা ছোট ডিঙি নৌকা এ দিকেই আসছে। সে সবাইকে দেখায় নৌকাটা। সবার চোখ সামনের দিকে ছুটে যায়। নৌকাটা চোখের কাছে এগিয়ে আসতে-না-আসতেই ওদের চোখে আর একটা নৌকা ভাসে। জাহাঙ্গীর মনোয়ারের দিকে চোখ ফেরায়।
‘ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না, মনোয়ার।’
মনোয়ার বলে, ‘কী করবি?’
‘দেখা যাক।’
জাহাঙ্গীরের সতর্কদৃষ্টি মুহূর্তেই একবার বিলটা ঘুরে আসে। সামনের দিকে থেকে আরও তিন-চারটা নৌকা এদিকেই এগোচ্ছে। পেছনেও তিন-চারটা ঘাসি নৌকা। মুহূর্তেই এত নৌকা এল কোত্থকে? ওরা কারা? প্রশ্ন একঝলকে জাহাঙ্গীরের মাথার ভেতরে চক্কর খায়। মনোয়ারের দিকে তাকায় জাহাঙ্গীর।
‘দু-একবার ফাঁকা আওয়াজ করে দেখো তো।’
মনোয়ার এক মুহূর্তে কী ভাবে। তারপর সামনে তাকায়। বাতাসে শব্দ ওঠে দ্রাম। সেই শব্দ হওয়ার ভেতর হুমড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তোলে দ্রা...ম। আকাশে যেসব পাখি সবে পাখা মেলতে শুরু করেছিল, তারা গুলির শব্দে কয়েকবার পাক খেয়ে এদিক-ওদিক ছিটকে সরে গেল। আর সেই শব্দ মিলিয়ে যেতেই তারা দেখল, নৌকাগুলো এগোচ্ছেই। ইতিমধ্যে নৌকার সংখ্যা আরও বেড়েছে। চারদিক থেকে একটা গোলাকার মালার মতো প্রায় বিশ-পঁচিশটা নৌকা ঘিরে ধরেছে ওদের। এবার জাহাঙ্গীরের ভেতরে একটা প্রবল বিস্ময় জেগে ওঠে। গুলি হলো, পাল্টা গুলি চলল না। বরং নৌকাগুলো এগোচ্ছেই। তা হলে ওরা কী চায়? মনোয়ার, সাঈদ ও অন্য সবাই এ-ওর দিকে চোখ ফেরাল, তারপর জাহাঙ্গীরের দিকে। ব্যাপারটাতে ওরা এতই বিমূঢ় হয়ে গেল যে, অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। জাহাঙ্গীর বুঝতে পারে, সবাই ওর নির্দেশের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু সে চট করে সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। সে ঝটপট ছইয়ের ভেতরে ঢুকল। বন্দি লোকটা যেমন বসে ছিল, আছে। জাহাঙ্গীর ঢুকেই জিজ্ঞেস করে, ‘ঐ নৌকাগুলো কাদের?’
লোকটা কথা বলে না। জাহাঙ্গীর তাকে টেনে গলুইয়ের ওপর আনে। সামনে দেখায়।
‘বলো নৌকাগুলো তোমাদের কি না।’
লোকটা মাথা উঁচু করে, ‘হ্যাঁ, আমাদের। কেন, ভয় করছে?’
শুনে মেজাজ জ্বলে যায়। তবু কিছু বলে না জাহাঙ্গীর। সবাই লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রত্যেকের মুখে খণ্ড খণ্ড ঘন কালো মেঘ এসে জমাট বাঁধে। জাহাঙ্গীর ভেবে দেখল, এতগুলো ছেলের জীবন তার হাতে। উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই। নিজেদের কাছে যে গোলাগুলি আচে, তাতে কিছুক্ষণ হয়তো লড়ে যাওয়া যাবে, কিন্তু ওদের লোকজন অনেকম ওখানে গেরিলা ফাইটেরও কোনো সুযোগ নেই, মুখোমুখি লড়তে হবে। ফলে বেঘোরে প্রাণ যাবে। একবার ভাবল, লোকটাকে গুলির মুখে রেখে ওদেরকে সতর্ক করে দেবে। কিন্তু ভেবে দেখল জাহাঙ্গীর, ব্যাপারটা হাস্যকর। ইংরেজি ছবির হিরোর কাজ এটা। এখানে এটা করলে শেষে পস্তাতে হবে। ওরা নিশ্চয়ই একজন লোকের জন্যে অত বেশি ভাবনা-চিন্তা করবে না। ভাবতে গিয়ে কেমন নিস্তেজ হয়ে গেল জাহাঙ্গীর। নৌকাগুলো ইতিমধ্যে অনেক কাছাকাছি হয়েছে। শুধু একটু নিরাপদ দূরত্ব রেখে অপেক্ষা করছে। এই অবস্থায় আর সামনে এগোনো যায় না। জাহাঙ্গীর কিছু বুঝতে না পেরে বলে ওঠে, ‘মাঝি, নৌকা থামাও।’
চারদিকে কম করে হলেও বিশ-পঁচিশটা নৌকা। তাতে শ দু-তিনেক লোকের কম হবে না। সবার হাতেই অস্ত্র। এখান থেকে ঠিক বোঝা যায় না, কী ধরনের অস্ত্র সেগুলো। এরা যে কোনো গুপ্ত রাজনৈতিক দলের লোক, এতে কোনো সন্দেহ থাকে না। কিন্তু  কোন দলের? এরা কী চায়? এদের সম্পর্কে আগে পত্রপত্রিকাতে অনেক খবর-টবর দেখেছে। তখন অত বিশ্বাস হয়নি। এখন নিজের  চোখেই দেখছে। 
জাহাঙ্গীর কখনো কোনো রাজনৈতিক দল বা ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল না। এগুলো থেকে সে নিজেকে সব সময়ই দূরে সরিয়ে রাখত। স্কুলজীবনে তো এ নিয়ে মাথাই ঘামায়নি, কলেজে উঠে একটু-আধটু ভাবনা-চিন্তা করলেও কখনো সক্রিয় ছিল না। কিন্তু একাত্তরের মার্চে যখন সারা বাংলাদেশ টালমাটাল, তখন নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারে না জাহাঙ্গীর। শুধু বারবার মনে হয়েছে, দেশকে স্বাধীন করতেই হবে। তাই জাহাঙ্গীরের মতো এমন উদাসীন ছেলেও ছুটে গেছে সীমান্তের ওপারে। এসব ভাবতে গিয়ে খুব অবাক লাগল জাহাঙ্গীরের।
মনোয়ারা অবশ্য স্কুলজীবন থেকেই রাজনীতি করে। ও ছাত্রলগি শহর শাখার সদস্য ছিল। পঁচিশে মার্চের আগেই ও ট্রেনিং নিয়েছে। পরে গেছে সীমান্তের ওপারে। জাহাঙ্গীর অবশ্য মনোয়ারের অনেক আগেই যায়। তবু অনেকদিন ও ভেবেছে। ট্রেনিং নিতে সাহস পায়নি। মৃত্যুভয় বারবার ওকে ভেতর থেকে তাড়া করেছে। তারপর কী করে যে কী হয়ে গেল! বুকের ভেতরে কোত্থেকে একটা তীব্র, জেদি অনুভূতি ওকে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে এল, ট্রেনিং শেষ হলো, কমান্ডারের দায়িত্ব পেল, তারপর এই অপারেশনে। মনোয়ারের সাথে ট্রেনিং ক্যাম্পেই দেখা। সে তার অনেকদিনের বন্ধু। সাঈদ আর অন্যদের সাথে পরিচয় ক্যাম্পেই। সবাই মিলে জীবনের প্রথম অপারেশনে এসেছে অথচ...
জাহাঙ্গীর বুঝে উঠতে পারল না কী করবে। ওপাশের নৌকাগুলোতে কোনো শব্দ নেই, শুধু সারিবদ্ধ সতর্ক কতগুলো মানুষ প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে। জাহাঙ্গীর যখন এইসব দেখছে, তখন একটা নৌকা তরতর করে ওদের নৌকার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। নৌকার মাঝি ছাড়া একজন। ডিঙিটা এসে ওদের নৌকা ছোঁয়। সবাই সেই দিকে নির্বিকার তাকিয়ে থাকে। এই ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে যায় যে, জাহাঙ্গীর কিছুই বলতে পারে না। ডিঙি নৌকার সেই লোকটা প্রায় চিৎকার করে ওঠে, ‘কমান্ডার কে?’
সাথে সাথে অদ্ভুত খটখটে গলায় ডাকে, ‘মকবুল, চলে এসো।’
নির্বিকার মকবুল জাহাঙ্গীরদের নৌকা থেকে লাগোয়া ডিঙি নৌকার দ্বিধাহীন উঠে যায়। জাহাঙ্গীরসহ ওরা কেউ কোনো কথা বলতে পারে না। কেমন পরাজিত, ভীরু, অসহায় মনে হয়। জীবনের প্রথম অপারেশনেই এই ব্যর্থতা ওদের ভেতরটা ওলট-পালট করে দেয়।
জাহাঙ্গীর, মনোয়ার, সাঈদ, অন্য সবার দিকে তাকায়। সবাই অকস্মাৎ কেন শক্তিহীন হয়ে গেল, বুঝতে পারে না। ওদের হাতে এখনো অস্ত্র আছে। ইচ্ছে করলেই লড়াই করতে পারে। কিন্তু কাদের সাথে লড়াই করবে! ওরা রাজনৈতিক দলের লোক, ওরা বিপ্লবী। ওদের সাথে লড়াই করার মানে দেশপ্রেমিকদের সাথে আত্মঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া। জাহাঙ্গীর নিজেকে কিছুতেই বোঝাতে পারে না।
এইভাবে কিছুটা সময় চলে যায়। লোকটা জাহাঙ্গীরের দিকে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, ‘কমান্ডার কি তুমি।’
‘জি।’
‘অ। তা ওকে নিয়ে যাচ্ছিলে কোথায়?’
‘আমাদের ক্যাম্পে।’
‘কেন?’
‘আমরা ভেবেছিলাম উনি রাজাকার।’ ওকে অনেক কথাই জিজ্ঞেস করেছি আমরা। উত্তর পাইনি। তাই আমরা ভাবলাম রাজাকার, ভয়ে কথা বলছে না।’
‘বাহ্, চমৎকার যুক্তি! কথা বলছে না, তাই রাজাকার।’
লোকটার কণ্ঠে কৌতুক ঝরে পড়ে।
‘খুব ভুল জায়গায় হাত দিয়েছ ছোকরা। এদিকে বোধহয় আর কখনো আসোনি? নতুন নতুন আর্মস হাতে নিয়েছ তো, দুনিয়াটাকে সরার মতো দেখছ। এই যে এখানে আছ, এর এদিকে-ওদিকে পুরো মাইল পাঁচেক জায়গা এখন আমাদের, বুঝলে।’
জাহাঙ্গীর ব্যাপারটাকে সহজ করার চেষ্টা করে।
‘দেখুন, ব্যাপারটা...
‘আরে চুপ করো। আমাকে কিছু বোঝাতে হবে না।’
লোকটার কথাবার্তার ধরন দেখে মেজাজ বিগড়ে যায় জাহাঙ্গীরের। মনে হয়, এক ঘুষিতে তার চোয়ালটা উড়িয়ে দেয়। খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নেয় সে। শুধু বলে, ‘আপনি অকারণেই আমাদের ওপর চটছেন। ব্যাপারটা নেহাত ভুল বোঝাবুঝি থেকে হয়েছে। তা না হলে আমরা ওকে ধরে নিয়ে যাব কেন?’
‘কেন আবার, নিজেদের বাহাদুরি ফলাবে না।’
জাহাঙ্গীর বুঝল, লোকটাকে কিছু বলতে যাওয়া বোকামি। লোকটাও আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, ‘এখানে বীরত্ব দেখিয়ে লাভ নেই। যার যার অস্ত্র নামিয়ে রাখো।’
এবার ওরা ইতস্তত করতে থাকে। লোকটা বুঝতে পারে, ‘যদি বাঁচতে চাও রেখে দাও।’
সবাই বুঝতে পারে, মুক্তি বহুদূর। অস্ত্র নামিয়ে রাখা মানে আত্মসমর্পণ করা। ওরা জাহাঙ্গীরের দিকে তাকায়। মনটা কেবল স্মৃতির ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে। স্বপ্নের একটা সতেজ-সজীব টকটকে তাজা গোলাপ বুকের ভেতর আস্তে আস্তে ফুটছিল, এখন তা শুকিয়ে এক-একটা পাপড়ি হয়ে ঝরতে লাগল। আর তার পতনের প্রতিটি শব্দ জাহাঙ্গীরের বুকের ভেতরে তুমুল তোলপাড় করতে লাগল। সে বুঝতে পারল, ওরা কী চায়। কিন্তু বোকামি করে লাভ নেই। জাহাঙ্গীর তাকায় সবার দিকে। সবাই এক-এক করে অস্ত্রগুলো গলুইয়ের ওপর নামিয়ে রাখে। বুকটা শূন্য হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর দৃশ্যটা দেখতে পারে না। মুখ ঘুরিয়ে নেয়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
ওদের তিনটি নৌকাকে ঘেরাও করে অন্য নৌকাগুলো এগিয়ে চলে। ওরা বিশজন মুক্তিযোদ্ধা, অসহায় তাকিয়ে থাকে। একসময় গাছগাছালি-পরিবেষ্টিত একটা দ্বীপের মতো জায়গায় এসে নৌকাগুলো থামে। ওপরে টিনের চালার কয়েকটা ঘর দেখা যায়। একপাশে স্তূপাকার খড়ের গাদা। তার আবেশ জড়ানো গন্ধ ভেসে আসে।
‘নামো।’
সেই লোকটা বলে। ওরা এক-এক করে নামে। ওরা নামবার পর নৌকাগুলো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে পড়ে। সূর্য তখন অনেক ওপরে উঠে এসেছে। 
সবাইকে একটা দোচালা টিনের ঘরে ভরে দিয়ে সেই লোকটা মকবুলকে নিয়ে চলে যায়। দরজায় একজন পাহারায় থাকে। তার হাতে একটা হালকা রাইফেল। ওরা কেউ কোনো কথা বলে না। ঘরের মেঝেতে চাটাই পাতা। গোবরের বোঁটকা গন্ধ আসে। ক্লান্তিতে বসে পড়েছে সবাই। কেউ কেউ গা এলিয়ে দিয়েছে।
জাহাঙ্গীর বসে পড়েছিল এক কোণে বেড়ায় ঠেস দিয়ে। সে ভাবছিল, এখান থেকে কি মুক্তি পাওয়া যাবে? ওদেরকে এখানে নিয়েই-বা এল কেন? গুপ্ত রাজনৈতিক দলের সদস্য ওরা। ‘আমাদের আটকে রেখে ওরা কী করতে চায়?’ এখান থেকে পালাবে, তার কোনো পথ নেই। তা হলে?
এইসব যখন ভাবছে, তখন দুজন লোক ঘরে ঢোকে। ওরা চমকে তাকিয়ে দেখে; ওদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে এসেছে। এত বেলা পর্যন্ত কিছুই খাওয়া হয়নি। খিদেয় পেটে পাক দিচ্ছে। কিন্তু কারোরই তেমন খাওয়া হলো না। জাহাঙ্গীরের একেবারেই খেতে ইচ্ছে করছে না। মুখটা বারবার ফিরে আসে।
কোনো রকমে খাওয়া শেষ হলে আর-একটা লোক ঘুরে ঢুকল। সবাই তাকাল সেদিকে। বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে। ঝকঝকে গায়ের রং। এসেই বলল, ‘কিছু মনে করবেন না। বেলা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়িতে এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা করা গেল না।’
ব্যবহারটা অচেনা। ওরা অবাক হয়। লোকটা বলে কী! ঠাট্টা করছে না তো! জাহাঙ্গীর তার দিকে তাকায়। লোকটা হাসে।
‘কী, আমাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, তাই না?’
লোকটার কথায় জাহাঙ্গীর সাহস পায়। বলে, ‘কিছুমনে করবেন না, আপনার পরিচয় জানলে খুশি হব।’
‘আমার নাম আলম। একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী। এর বেশি আমার আর কোনো পরিচয় নেই।’
আলমের মুখের দিকে সবাই তাকিয়ে থাকে। তাতে একধরনের প্রত্যাশা ফুটে ওঠে। সে প্রত্যাশা যে কী, তা ঠিক বোঝা যায় না। শুধু দোচালা টিনের ঘরের আধো আলোছায়ার অপরিচিত এক গুমোট নিস্তব্ধতার মধ্যে কয়েকটি মুখ মুহূর্তের জন্যে ফ্রিজ হয়ে যায়।
জাহাঙ্গীরও যে কম বিস্মিত হয়েছে তা নয়। একটু আগে যে লোকটা ওদের এখানে নিয়ে এসেছে কিংবা ক্রূর চেহারার সেই মকবুল, দুজনের সাথেই কী পার্থক্য আলম সাহেবের। বোধহয় নিজের অগোচরে একটা বিশ্বাস জন্ম নেয় জাহাঙ্গীরের মনে, তাই সাহস করে কথাটা বলতে পারে সে।
‘আমাদের কি আটকেই রাখবেন, আলম সাহেব?’ আলম হাসে। সেই হাসিটা এমন যে এসেই দ্রুত মিলিয়ে যায়।
‘ক’টা দিন অন্তত আমাদের এখানে থাকুন। এত তাড়া কিসের?’
এবার একটু অবাক হয় জাহাঙ্গীর। সেটা আলমের আতিথেয়তার জন্যে নয়, তার উদাসীনতার জন্যে। আলম সাহেব নিশ্চয়ই জানেন, ওরা মুক্তিযুদ্ধ করছে। এখানে আটকে থাকলে ওদের চলবে না। তার পরও কেমন নিস্পৃহভাবে বলছে, তাড়া কিসের। একবার ভেবেছিল কিছু কড়া কথা শোনায়। শেষ পর্যন্ত বলে না, চেপে যায়। আলম নিজেই বলে, ‘আপনারা কিছুদিন এখানে থাকলেই বুঝতে পারবেন, আপনারা শুধু শুধু সোনার হরিণের পেছনে ছুটছেন।’
জাহাঙ্গীর থাকতে পারে না?
‘কেন?’
আলম হাসতে থাকে।
‘কারণ, যাদের নেতৃত্বে আপনারা পরিচালিত হচ্ছেন, তারা শ্রেণিচরিত্রের দিক থেকে বুর্জোয়া, পুঁজিবাদের ধারক-বাহক। ওরা সাম্রাজ্যবাদের দালাল। ওরা কিছুতেই দেশকে মুক্ত করতে পারে না।
জাহাঙ্গীরের কাছে এবার আলম সাহেবের কথার অর্থগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়। আলম সাহেবের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। তবু জাহাঙ্গীর যুক্তি দেবার চেষ্টা করে।
‘আপনি যে নেতৃত্বের কথা বলছে, আলম সাহেব, এখন কিছুই আর তাদের একক ব্যাপার নয়। এখন যারা একে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, তাদের হাতেই নেতৃত্ব এসে যাবে।’
‘না, তা সম্ভব নয়। কারণ ক্ষমতা ওরাই কুক্ষিগত করে রেখেছে। ওরা তো অন্য জায়গায় বাঁধা।’
‘তা হলেও সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারলে ওদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়া অসম্ভব কিছু নয়। আপনারাই সে দায়িত্ব নিন না!’
জাহাঙ্গীরের কথায় আলম সাহেব কিছুক্ষণের জন্যে থমকে থাকে। জাহাঙ্গীর বুঝতে পারে, এই দায়িত্ব নেয়ার মতো দলীয় শক্তি ও জনসমর্থন তাদের নেই। তাছাড়া আন্দোলনের নিজস্ব গতি আছে, সেই গতির সাথে তাল মেলাতে পারেনি তারা। এটা তাদের ব্যর্থতা, সেটা বোঝার ক্ষমতাও তাদের নেই। এটাই জাহাঙ্গীরের ভালো লাগে না। সক্রিয় রাজনীতি না করলেও রাজনৈতিক দলগুলোর তাত্ত্বিক কথাবার্তা সে একেবারেই সইতে পারে না। ওরা যত কথা বরে,তার সিকি ভাগ কাজ করলেও অনেক কিছু হতে পারত। তা না করে শুধু কথা বলা। এই কথার কোনো মানে হয়! এক রকম বিরক্তি বোধ করে জাহাঙ্গীর।
বেশ কিছুক্ষণ পর কথা বলে আলম সহেব। তার মুখ গম্ভীর। চোখ ঈষৎ অস্বাভাবিক। বোঝা যায়, তিনি জাহাঙ্গীরের কথাকে স্বাভাবিকভাবে নেননি।
‘আমি এখন চলি। আপনাদের সাথে পরে আলাপ করব।’ বলেই উঠে চলে গেলেন তিনি। জাহাঙ্গীর বুঝল, কাজটা ভালো হলো না। কী দরকার ছিল আলম সাহেবকে আঘাত দেবার। আসলে সে-ও তা চায়নি, তবু কেমন করে যে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। নিজের বোকামির জন্যে আফসোস হলো তার। সবার দিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে মনোয়ারকে ডাকল সে।
মনোয়ার যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল।
‘বল।’
‘কাজটা বোধ হয় ভালো হলো না, তাই না?’
‘তুই গেলি কেন শালার সাথে আলাপ করতে। জানিস তো ওরা ঐ রকমই হয়। শুদু তাত্ত্বিক বুলি কপচায়, কাজের বেলায় ঘোড়ার ডিম। মানুষ খুন করা ছাড়া ওদের আর কোনো কাজ আছে নাকি!’
বোঝা যায় মনোয়ার খুব খেপেছে। ওর খ্যাপারও কথা। যে আদর্শের জন্যে ও লড়াই করছে, তার বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন আলম সাহেব। তাছাড়া এমনিতেই সে ওদের নাম শুনতে পারে না।
জাহাঙ্গীর শুধু বলে, ‘এখন কী হবে বল তো।
মনোয়ার রেগে যায়।
‘যা হয় হবে।’
এরপর কিছু বললেই মনোয়ার আরও খেপে যাবে। তার চেয়ে চুপচাপ থেকে দেখা যাক কী হয়। সাঈদ ও অন্যরা একেবারেই চুপচাপ। যে উৎসাহ নিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকেছিল, তা কোথায় উবে গেছে। ভাবতে গিয়ে জাহাঙ্গীরের নিজেকেই খুব অপরাধী মনে হলো।
ঘর থেকে বেরোনোর তেমন কোনো উপায় নেই। মাঝে মাঝে পায়খানা-পেচ্ছাবের জন্যে বাইরে আসে। তখন পাহারাদারটা সতর্ক দৃষ্টি রাখে। এখান থেকে পালাবার কোনো উপায় নেই। তাছাড়া পথঘাটও ওদের অচেনা। বসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠল ওরা।
দেখতে দেখতে রাত হয়ে আসে। গাঢ় অন্ধকার এসে ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়। ঘরের ভেতরে অন্ধকার আরও তীব্র হয়। ঝিঁঝি পোকা একটানা নৈঃশব্দ্যকে টুকরো টুকরো করতে থাকে। কেউ কোনো কথা বলছে না। সবার নিশ্বাসের একটা ভুতুড়ে আওয়াজ শোনা যায় শুধু। রাত কত হলো, কিছুই বোঝার উপায় নেই। 
একসময় একটা আলোর রশ্মি ঘরে ঢুকতেই ওরা প্রায় লাফিয়ে ওঠে। দেখে দুজন লোক ঘরে ঢুকছে। হাতে স্টেনগান, পেছনে আলো হাতে পাহারাদার। ওদের মধ্যে একজনের কণ্ঠ খুলে গেল।
‘আপনারা সবাই উঠে পড়ুন। আমাদের সাথে আপনাদের যেতে হবে। নেতা ডেকেছেন।’
জাহাঙ্গীরসহ সবাই বাইরে বেরিয়ে আসে এক-এক করে। কোথায় যাচ্ছে, বুঝতে পারে না ওরা। নেতা কোথায় থাকে তা-ও জানে না। নিঃশব্দ পায়ে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর এগিয়ে যায় দক্ষিণে। সামনে-পেছনে দুটি স্টেনগান। মাঝখানে ওরা বিশ জন মুক্তিযোদ্ধা।
আকাশে চমৎকার চাঁদ উঠেছে। সেই আলোকে পথ হাঁটছিল। একসময় ওরা একটা বড় মাঠের কাছে এসে থামে। দিগন্তব্যাপী এক শূন্যতা খাঁ খাঁ করছে। দূরের কিছুই নজরে আসে না। আশপাশের গাছপালাগুলোকে ভুতুড়ে মনে হয়। জাহাঙ্গীর হাঁটছিল সবার আগে আগে। এসে থামতেই দেহে একটা প্রবল শীতলতা অনুভব করে। বুকের ভেতর থেকে যেন খানিকটা রক্ত সরে যায়। সে দেখে, মাঠের মাঝখানে আরও কিছু লোক। তাদের কাউকেই তারা চেনে না। সবার হাতেই স্টেনগান। জাহাঙ্গীরসহ সবাইকে ওরা মাঠের মাঝখানে নিয়ে জড়ো করে। জাহাঙ্গীর সবাই ডানে। জায়গাটা হঠাৎ খুব চেনাচেনা মনে হয় জাহাঙ্গীরের।
কী আশ্চর্য! অবাক না হয়ে পারে না সে। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন মা, আদরের ছোট বোনটা। সে তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে মার পা স্পর্শ করে। ছোট্ট বোনটাকে আদর করে। মার চোখে জল। মুখটা ঘুরিয়ে ছুটে যেতে গিয়ে হোঁচট খাওয়ার সাথে সাথে ট্রা-রা-রা-রা শব্দ ওঠে। চমকে মুখ ফেরাতেই দেখে তার পাশ থেকে তিনজন লুটিয়ে পড়ল। বাতাসে একটা মর্মান্তিক আর্তনাদ বহুদূর পর্যন্ত ভেসে গেল।
জাহাঙ্গীর সইতে পারে না। তার সম্পূর্ণ হৃৎপিণ্ড ছিটকে বেরিয়ে আসতে চায়। সে চারদিকে একবার ভালো করে তাকায়। শূন্য মাঠে সে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায় না। মা, ছোট বোনটা, মনোয়ার, সাঈদ ওরা সব গেল কোথায়? জাহাঙ্গীরের ভীষণ ভয় করতে থাকে। সে এক মুহুর্ত আর দেরি না করে পুবদিক লক্ষ্য করে মাঠের ভেতর দিয়ে খুব দ্রুত ছুটতে থাকে। আকাশ, পৃথিবী, নক্ষত্র তার সাথে সাথে ছুটে যায়। দুই পাশ থেকে বাতাস শাঁই শাঁই শব্দে চাবুক মারতে থাকে। জাহাঙ্গীরের কানে অসংখ্য কণ্ঠের আঃ আঃ শব্দ এসে ভীসণ জোরে আঘাত করতে থাকে। দু’হাতে কান চেপে ধরে জাহাঙ্গীর। পথ ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকে। ছুটতে ছুটতে এক জায়গায় এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে। কপালে খানিকটা কেটে গিয়ে রক্ত বেরোয়।
ঘন সবুজ প্রকৃতি, সুনিবিড় গাছপালা আর তার ভেতর থেকে লাল রঙের একটি সূর্য ক্রমশ উপরে উঠে আসছে। জাহাঙ্গীরের চোখে কেমন আলতো ঘুম নেমে আসে। সে হাত দিয়ে রক্তমাখা ঘন সবুজ প্রকৃতি স্পর্শ করার চেষ্টা করে, পারে না। রক্তাক্ত প্রকৃতি ওর চোখের সামনে পতাকার মতো পতপত করে উড়তে থাকে। যন্ত্রণায় হৃৎপিণ্ড ভেদ করে একটি অসহায় চিৎকার শূন্যে সুদূরে শাঁই শাঁই করে উড়ে চলে যায়: ‘জয় বাংলা..., জয় বঙ্গবন্ধু...।’

0 comments:

Post a Comment