একটি ছবির গল্প
মুস্তাফা মাসুদ
রিপন তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র। ক্লাসের লেখাপড়ায় যেমন তুখোড়, তেমনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও। শহিদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও দিবস-বিজয় দিবস উপলক্ষে স্কুলের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও পেয়ে আসছে প্রতি বছর। ওর প্রতিযোগিতার বিষয় থাকত ছবি আঁকা। ছবি আঁকতেই তার বেশি ভালো লাগে। তাই আগেই ও মনস্থির করে ফেলেছিল, ভবিষ্যতে আর্ট কলেজে পড়বে। বড় শিল্পী হবেÑজয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, কাইয়ূম চৌধুরী, হাশেম-খান, রফিকুন নবী, ফরিদা জামানদের মতো বড় শিল্পী।
স্কুলের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলেও এর বাইরের কোনো প্রতিযোগিতায় তখনো অংশ নেয়া হয় নি রিপনের। সেবারই প্রথম শিশু একাডেমী আয়োজিত জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় যোগ দিলো। এই প্রতিযোগিতায়ও ছবি আঁকা বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হল ও। পরপর দুই বছর। আর এতেই ওর সামনে এল এক দারুণ সুযোগ। পূর্ব-ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় একটি আন্তর্জাতিক শিশু-সম্মেলন হবে, এর নাম ‘ব্যানার অব পিস’। সারা পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের প্রতিভাবান শিশুরা এতে যোগ দেবে। শিশু-প্রতিনিধি হিসেবে রিপনও তাতে যোগদানের সুযোগ পেয়ে গেল। ওকে ছবি আঁকার শিল্পী হিসেবেই বিবেচনা করা হল। গিটারে পরপর দু’বছর চ্যাম্পিয়ন রিফাতও এই সুযোগ পেল। ওদের দলনেতা হিসেবে মনোনীত হলেন নাজিমউদ্দিন ভাইয়া। শিশু একাডেমীর অফিসার তিনি।
জীবনে এই প্রথম বিদেশে যাওয়া। মা-বাবা আর ছোট বোনটির জন্য রিপনের বুকের ভেতরটা হাহাকার করতে থাকে। তবুও শেষমেশ তা সামলে নেয় এবং তিন জন এক সময় ঢাকা বিমানবন্দর থেকে অ্যারোফ্লোটের বিমানে চাপে। বিমানে মুম্বাই, করাচি, তাশখন্দ হয়ে রাশিয়ার মস্কো। সেখানে ঘণ্টা-আটেকের ট্রানজিট মানে যাত্রাবিরতি, তারপর সেখান থেকে সোজা বুলগেরিয়ার সোফিয়া বিমানবন্দর। বুলগেরিয়ায় ওদের থাকতে দেয়া হল সোফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি চলছে। তাই এখানেই ঠাঁই হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিশু-প্রতিনিধি ও তাদের দলনেতাদের। সবার আগমনে এক হুলস্থুল পরিবেশ। আনন্দে টইটম্বুর যেন চার দিক।
দীর্ঘ বাইশ দিন সম্মেলন উপলক্ষে কর্মসূচি চলল। বক্তৃতা, আলোচনা আর নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে বিভিন্ন জায়গায়। একটি অনুষ্ঠানে বিশ্বশান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র এলেন, উদ্বোধন করলেন অনুষ্ঠান। ঐতিহাসিক স্থানসমূহ পরিদর্শনেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মাঝে মাঝে। বুলগেরিয়ায় কয়েক শ’ বছর ধরে চলেছিল অটোমান তুর্কিদের শাসন। নানা স্থানে ছড়িয়ে আছে তাদের ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ, সেগুলো সযত্নে সংরক্ষণ করা রয়েছে বিভিন্ন জাদুঘরে। সেসব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হল ওদের।
সম্মেলনের শেষ দিকে শিশু-প্রতিনিধি দলকে নিয়ে যাওয়া হয় কৃষ্ণসাগর দেখাতে। সোফিয়া থেকে প্লেনে বুরগাস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে বাসে সোজা সাগরতীরের পাঁচতারা হোটেল। এখানেই রাতযাপনের ব্যবস্থা তাদের। সকালেই যেতে হবে কৃষ্ণসাগর দেখতে। সেখানে সানবাথ বা সূর্যস্নান হবে। নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত সমুদ্রভ্রমণ হবে। আনন্দ আর হৈ-চৈ হবে। নানা রকম প্রতিযোগিতাও হবে। ধুমসে কাটবে সারাটা দিন। এক চমৎকার স্বপ্ন বুকে নিয়ে হোটেল-ক্যান্টিনে রাতের খাবার খেতে যায় রিপন, রিফাত, নাজিম ভাইয়া আর ওদের গ্রুপের অন্য ছেলে-মেয়েরা। সবাই এশীয় দেশ থেকে আসা। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড এবং জাপানের শিশুরা রয়েছে এই গ্রুপে।
হঠাৎ রিপনের পাশের খালি চেয়ারটায় এসে বসে জাপানি প্রতিনিধি দলের সদস্য শিনজো আকিনো। সদা হাস্যময় এক উজ্জ্বল কিশোর। রিপনের মতো সেও ছবি আঁকার শিল্পী হিসেবে মনোনীত হয়ে এসেছে। চেয়ারে বসার আগেই সে রিপন, রিফাত আর নাজিম ভাইয়ার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে কুশল বিনিময় করে। মুখ থেকে হাসি ঝরছে ঝরনার মতো। ওর সঙ্গে এর আগে রিপনদের অল্প-স্বল্প হাই-হ্যালোমার্কা পরিচয় থাকলেও তেমন কথাবার্তার সুযোগ হয় নি। এখন মুহূর্তেই ও এমন গভীরভাবে বন্ধুত্ব জমিয়ে তুলল যে, কে বলবে ওরা ভিনদেশি আর স্বল্প-পরিচিত!
কথায় কথায় শিনজো যখন জানতে পারল রিপনরা বাংলাদেশ থেকে গিয়েছে, তখন তার খুশি যেন আর ধরে না। বারবার প্রশ্ন করেÑরিয়েলি? আর ইউ ফ্রম ব্যাংলাদেশ?Ñসত্যি তোমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছো? আমি ভেবেছিলাম তোমরা ইন্ডিয়ান।
Ñনো, উই আর ফ্রম বাংলাদেশ। উই আর বাঙালিÑরিপন হাসিমুখেই জবাব দেয়। তখন শিনজো বিড় বিড় করে নিজে নিজেই বলতে থাকেÑ ব্যাংলাদেশ অব শেখ মুজিবুর রহমান। আ গ্রেট লিডারÑরিয়েলি আ গ্রেট লিডার। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলেÑ জানো, আমি তোমাদের দেশ সম্পর্কে অনেককিছু জানি। তোমাদের বঙ্গবন্ধুকে জানি। তাঁর ছবি দেখেছি আমি। জান তো, ১৯৭৪ সালে তিনি জাপান গিয়েছিলেন সরকারি কাজে। তাঁর সঙ্গে তাঁর এক মেয়ে আর ছোট ছেলেটাও গিয়েছিল। তাঁদের একটি গ্রুপ-ছবি এখনো আছে আমাদের বাসায়Ñ আমাদের ছবির অ্যালবামে। আমার বাবা জাপানের একটি বড় পত্রিকা জাপান টাইমসের সিনিয়র সাংবাদিক। ওই সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের নানা প্রোগ্রামের খবর সংগ্রহ করতে হত তাঁকে। বঙ্গবন্ধুর খুব কাছাকাছি যাওয়ার এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলারও সুযোগ হয়েছিল বাবার। তাঁর মুখে শুনেছি, এক্সিলেন্ট এক মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর কথাবার্তা, চলফেরাÑ সবই ছিলো এক মহান দেশনায়কের মতো। আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর এক মানুষ। বাবা এখনো তাঁর কথা বলেন গর্বের সঙ্গে। এমন একজন দেশপ্রেমিক মানুষকেও বাঙালিরা খুন করল কেনÑ বাবা এ-প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে পান না। তবে আমি পড়েছি, বঙ্গবন্ধুকে যারা খুন করেছিল তারা বাংলাদেশের বন্ধু ছিল না এবং তারা সংখ্যায় ছিল খুবই কম; অবশ্য, তাদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরাও হাত মিলিয়েছিল।....
শিনজোকে যেন কথার নেশায় পেয়ে বসেছে। সে আরও কী বলতে যাবে, এমন সময় নাজিম ভাইয়া ওকে থামান। তারপর আবেগ-জড়ানো গলায় বলেনÑডিয়ার শিনজো, অশেষ ধন্যবাদ তোমাকে। আমাদের বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তোমার ও তোমার বাবার ভালোবাসা, আবেগ অতুলনীয়। তবে কী জানো, আমরা বঙ্গবন্ধুকে মারি নি; যারা মেরেছে তারা বাঙালি নামের অযোগ্য; এমনকি মানুষ নামেরও অযোগ্য। তারা খুনিÑস্রেফ খুনি। দে আর কিলারস অ্যাট অল। আর ওই যে তুমি বললে, তারা বাংলাদেশের বন্ধু ছিল না এবং তারা সংখ্যায় ছিল খুবই কম। খুবই সত্যি কথা। এখনো দেশের অগণিত মানুষ বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসে। তাঁর জন্য চোখের জল ফেলে।
এরিমধ্যে টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। নাজিম ভাইয়া বলেনÑএখন আর কথা নয়। তাড়াতাড়ি খেয়ে নেওয়া যাক। কাল খুব সকালে উঠতে হবে। মাই ডিয়ার শিনজো, তোমার বাকি কথা কাল শুনবÑ ঠিক আছে? শিনজো মিষ্টি করে হাসে, তারপর বলেÑ ঠিক আছে ভাইয়া। বলেই খাবারে মন দেয় সে।
বুলগেরিয়ার একেবারে পূর্ব প্রান্তের জেলা বুরগাস। এটি বুরগাস বিভাগের রাজধানী ও জেলা শহর। কৃষ্ণসাগরের পশ্চিম তীর বুরগাসের প্রান্ত ছুঁয়ে গেছে। সাগরের ওপারেই তুরস্ক। টলটলে কালো পানির জন্যই সাগরের নাম ব্ল্যাক সি বা কৃষ্ণসাগর। কূলের কাছাকাছি নেমে ইচ্ছেমতো গোসল করা যায়। সাঁতরানো যায়। পানি ছোড়াছুড়িও খেলা যায়। আবার সৈকতে বালির মধ্যে শুয়ে সূর্যস্নান বা সানবাথ করা যায়। সাগরের মধ্যে সূর্যোদয়ও দেখা যায় সকাল-সকাল এলে।
রিপনরা সূর্য ওঠার বেশ আগেই সাগর-সৈকতে পৌঁছে যায়। ওরা বিশ্বাসই করতে পারছে না ওদের সামনেই বিশাল কালো জলের অতল সমুদ্র বিস্ময়ভরা কৃষ্ণসাগর। বিশাল বিশাল কালো ঢেউগুলো দৈত্যের মতো ছুটে চলেছে। নাজিম ভাইয়া তার ক্যামেরায় তাড়াতাড়ি দ্রুত ধাবমান ঢেউয়ের ছবি তুললেন কয়েকটা। হঠাৎ রিফাত চিৎকার করে বলেÑ ওই যে! ওই যে দেখো রিপন, সূর্য উঠছে! নাজিম ভাইয়া, দেখুনÑ দূরে সমুদ্রের ওপরে খানিকটা জায়গা কেমন সোনালি হয়ে উঠেছে। মনে হয় ওখানেই সূর্য দেখা যাবে।
শুধু রিপনরা নয়, প্রতিনিধি দলের সবার দৃষ্টিই সাগরের ওই বিশেষ স্থানে। ওপারে দিগন্ত-রেখা নজরে আসে না, বিশাল সমুদ্রের সঙ্গে তা একাকার হয়ে গেছে। একারণেই সূর্যোদয়ের পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে সাগরের উথাল-পাথাল ঢেউয়ের মধ্যে। যেন সমুদ্রের বুক ফুঁড়েই মাথা তুলবে সূর্য। আস্তে আস্তে সময় পার হয়। সোনালি আভাও ক্রমে উজ্জ্বলতর হয়। নাজিম ভাইয়া তাঁর ক্যামেরায় ঘন ঘন ক্লিক ক্লিক করছেন। সবাই এক পলকে তাকিয়ে আছে দূরেÑযেন সূর্যোদয়ের সেই মনোরম সৌন্দর্য ওরা একটুও মিস না করে। বেশ খানিকক্ষণ পর সোনালি সূর্যের সামান্য অংশ ভেসে উঠল পানির ওপর। যেন সোনার থালার একাংশ; মনে হয়, প্রবল ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। কিন্তু ভাঙে না, কেবলই দোল খায়। উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লুটোপুটি খেলছে যেন!
সময় গড়িয়ে যায়। সূর্যের আকারও একটু একটু করে বড় হয়। সব শেষে সাগরের পানি ফুঁড়ে সকালের সূর্য পুরোপুরি মাথা তোলে ওপরে। বিশাল এক আলোর বল যেন শূন্যে ঝুলে আছে। নিচে কৃষ্ণসাগরের অথৈ জলের ঢেউগুলো যেন তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। সে-এক অপরূপ দৃশ্য!
এরিমধ্যে সূর্য বেশ ওপরে উঠে গেছে। তারপরও অনেকেই তাকিয়ে আছে সেদিকে। ঠাণ্ডাও বেশ আছে। সেই ঠাণ্ডার সঙ্গে সূর্যের মিষ্টি উত্তাপ মিশে ভারি আরামের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে সবার শরীরে। হঠাৎ মাইকে ঘোষণা হলÑ সানবাথের আগে একটা প্রতিযোগিতা হবে এই সৈকতে। যারা গানের শিল্পী তারা গান করবে। নৃত্যশিল্পীরা নাচ করবে। ছবি আঁকার শিল্পীরা ছবি আঁকবে অর্থাৎ যারা যে বিষয়ের শিল্পী তারা তাই করবে। মাইকের ঘোষণা শুনে সবাই সৈকতে বালির ওপর গিয়ে দাঁড়ায়। আয়োজক সমুদ্রতীরের বুরগাস জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী, গাইড ও দলনেতারা বিষয় অনুযায়ী প্রতিযোগীদের আলাদা করে নেন।
গান ও নাচের শিল্পীরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। ছবি আঁকার শিল্পীও মোটামুটি কম হল না। সৈকতে নরম বালির ওপর একটা করে স্ট্যান্ড দেয়া হল, তাতে ছবি আঁকার মোটা কাগজ ক্লিপ দিয়ে সাঁটানো। প্রতিটা স্ট্যান্ডের পাশে তুলি, রং, পেন্সিল ইত্যাদি। বালির মধ্যে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকতে হবে। সামান্য দূরে কৃষ্ণসাগরের ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে ছলাৎ ছলাৎ। এই পরিবেশে ছবি আঁকতে হবে ভেবে ওরা খুবই মজা পায়। সবাই বালির মধ্যে দাঁড়িয়েছে ২/৩ হাত দূরে দূরে। ছবি আঁকার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নেই। সময় দেয়া হল ৫০ মিনিট। সবাই একমনে ছবি আঁকতে লেগে যায়। প্রতিযোগিতা বলে কথা! তাও বিদেশের মাটিতে। সবাই ভালো করার চেষ্টায় ব্যস্ত।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটে যায়। রিপনের ছবি আঁকা শেষ। সে এঁকেছে বাংলাদেশের মাঠ। সেখানে নানান ফসলের সমারোহ। কয়েকটা রাখাল বালক গরু তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা পাখি উড়ে যাচ্ছে ওদের মাথার ওপর দিয়ে। যেন একেবারে জীবন্ত। ছবির নিচে ক্যাপশন দিয়েছেÑ বিউটি অব বাংলাদেশ। নিজের ছবি আঁকা শেষ হয়েছে বলে এদিক-ওদিক তাকায় রিপন। তার ডান পাশেই রয়েছে ভারতের সীমা রাঠি আর আশা পারেখ। একটু দূরে তাকাতেই শিনজোকে দেখতে পায় ও। ততক্ষণ শিনজোরও ছবি আঁকা শেষ। কী এঁকেছে সে? নিশ্চয় জাপানের কোনো দৃশ্যটৃশ্য হবেÑ ভাবে রিপন। কিন্তু এখান থেকে কিছু দেখা যাচ্ছে না। ওখানে এ-মুহূর্তে যাওয়াও যাবে না। একটু পরেই বিচারকেরা আসবেন। তারা বিচার করে সিলেক্ট করবেন ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড। সেভাবেই প্রাইজ দেয়া হবে।
প্রতিযোগীরা যার যার ছবির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তিনজন বিচারক এলেন। তারা কিশোর শিল্পীদের আঁকা ছবিগুলো দেখছেন আর রেজাল্ট-শিটে নাম্বার দিচ্ছেন। শিল্পীর নাম-পরিচয় এবং ছবির নামও লিখে নিচ্ছেন সেইসঙ্গে। এরপর এক সময় বিচার-কাজ শেষ হল। তিনজন বিচারকের নম্বর যোগ করা হল। হঠাৎ দেখা গেল বিচারকদের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা। তারা শিনজোকে ঘিরে ধরেছেন। কারণ কী, কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না। শিনজো কি গুরুতর কোনো ভুল বা অন্যায় করে ফেলেছে? দারুণ বাংলাদেশ-ভক্ত এই ছেলেটির জন্য রিপনের উদ্বেগ বাড়ে। এমন সময় দেখা যায়, বিচারকদের একজন শিনজোর ডান হাত নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে হাসিমুখে ওকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন অপূর্ব সুন্দর একটা ছবি আঁকার জন্য। অন্য দু’জনও তার পিঠ চাপড়ে আদর করছেন। এসব দেখে রিপনের দুশ্চিন্তা দূর হয়। তবে ঘটনা কী জানার জন্য সে অস্থির হয়ে পড়ে।
বিচারকদের মধ্যে যার মাথার সবগুলো চুল বরফ-সাদা, তিনি বললেনÑএখন আমি ছবি আঁকা প্রতিযোগিতার রেজাল্ট ঘোষণা করব। আগে নিচের দিক থেকে বলি। প্রতিযোগিতায় থার্ড হয়েছে মিস সীমা রাঠি, তার দেশ ভারত আর তার ছবির শিরোনাম দ্য তাজ অব আগ্রা। সেকেন্ড হয়েছে মি. রিপন রাহাত, দেশ বাংলাদেশ আর তার ছবির শিরোনাম বিউটি অব বাংলাদেশ। বন্ধুরা, এবার আমি ঘোষণা করব সেই নামটি, যে কি না এই চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়েছে। তার নাম... তার নাম মি. শিনজো আকিনো, দেশ জাপান আর তার ছবির শিরোনাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: আ গ্রেট লিডার। আহ্! কী সুন্দর ছবি এঁকেছে সে! রং, রেখা আর একসপ্রেশনে একেবারে জীবন্ত যেন! বন্ধুরা, জানো, আমি সেই নেতাকে নিজের চোখে দেখেছি। ১৯৭২ সালে তিনি যখন প্রথম রাশিয়া সফরে যান, আমি তখন মস্কোয়। আর্ট বিষয়ক এক সেমিনারে সেখানে গিয়েছিলাম। কী ক্যারিসম্যাটিক ব্যক্তিত্ব আর চেহারা! চলাফেরা আর কথাবলার ধরন! তাঁর চেহারা আমার মনে গেঁথে রয়েছে আজো। মি. শিনজো সেই নেতার ছবিই শুধু আঁকে নি; সেইসঙ্গে রয়েছে তাঁর দুই ছেলে-মেয়েওÑ অবশ্য তাদেরকে আমি কখনো দেখি নি। একজন ভিনদেশি হয়েও মি. শিনজো যে দরদ আর ভালোবাসায় মহান মুজিবের ছবি এঁকেছে, তা এককথায় অসাধারণÑএক্সিলেন্ট। তাকে আমরা অভিনন্দন জানাচ্ছি।
রিপনের বুঝতে কষ্ট হয় নাÑশিনজো সেই ছবিটাই তার ক্যানভাসে এঁকেছে, যেটির কথা কাল রাতে ক্যান্টিনে বসে সে বলেছিল। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের সময় তোলা ছবিÑ যেটিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রয়েছেন তাঁর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা আর ছোট ছেলে রাসেল; যে-ছবিটি জাপানে শিনজোদের বাসায় তাদের পারিবারিক অ্যালবামে আছে এখনো। রিপন এগিয়ে যায় শিনজোর দিকে। অন্যরাও এগিয়ে আসে। ছবির দিকে তাকিয়ে রিপন শিনজোকে জড়িয়ে ধরে আবেগে। শিনজোও তাকে জড়িয়ে ধরে। রিপনের ঘাড়ের ওপর মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। যেন স্বজন হারানোর ব্যথায় সে নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না। বঙ্গবন্ধু যেন ওর একান্ত আপনজন।
শিনজোকে সান্ত¦না দেয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পায় না রিপন। সেও অঝরে কাঁদতে থাকে নীরবে।
0 comments:
Post a Comment