Monday, July 27, 2020

একটি বটোবৃক্ষ রোপন বা একটি দীর্ঘ পথের জন্ম গল্প (কাজী সাইফুল ইসলাম)



একটি বটোবৃক্ষ রোপন বা একটি দীর্ঘ পথের জন্ম
কাজী সাইফুল ইসলাম

১৯৩৮ সাল। বাংলার প্রধানমন্ত্রী আর শ্রমমন্ত্রী এক সাথে গোপালগঞ্জে আসবেন শরতের মেলা উদ্বোধন করতে। বাংলার এত বড় দু’ জন নেতা এক সাথে আসবেন তাই স্থানীয় নেতাদের চলছে প্রস্তুতি। বিশাল জনসভা করতে হবে। হাজার হাজার মানুষের ভিড় সামাল দিতে তৈরী করা হলো ভলান্টিয়ার গ্রুপ। 
এ ঘটনা নিয়ে গোপালগঞ্জের মুসলমানদের মধ্যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হলো। কিন্তু হিন্দুরা কিছুটা চুপচাপ। এতে মুসলমানদের কিছু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। কারণ গোপালগঞ্জে হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যা প্রায় সমান। স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে একটি ভলান্টিয়ার গ্রুপ করা হলো। এই ভলান্টিয়ার গ্রুপের লিডার বানিয়ে দেয়া হয়েছে মুজিবকে। হিন্দু মুসিলিম খ্রীষ্টান সব ধর্মের ছাত্ররাই এই গ্রুপে রয়েছে। প্রতি দিন ক্লাসের ফাঁকে গ্রুপের ছেলেদের ডেকে নিয়ে কাজের পরিকল্পনা ঠিক করে মুজিব। প্রয়োজন হলে বড়দের সাহায্য নেয়। 
কদিন পরে মুজিব লক্ষ করে- হিন্দু ছেলেরা আর আসছে না ভলান্টিয়ার গ্রুপের সাথে কাজ করার জন্য। কেন আসছে না তার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারছে না মুজিব। শেষে একদিন পরিতোষকে ধরে মুজিব জিগ্যেস করে, ‘ তোদের হইছে কী। ভালান্টিয়ার গ্রুপে নাম দিয়ে এখন সরে পড়েছিস কেনো?’
পরিতোষ শোনালো আসল ঘটনা,‘ আমাদের কংগ্রেসের নিষেধ আছে।’
‘ নিষেধ আছে!’
‘ হ, প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে এম ফজলুল হক মুসলীম লীগের সাথে জোট বানিয়েছে। সে জন্যই তো শ্রমমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীও আসছেন তার সাথে।’
এ কথা শুনে চোখ বড়বড় হয়ে যায় মুজিবের। কথা খুঁজে পায় না। নির্বাক হয়ে যায়। বলে কি! কিন্তু যে করেই হোক, অনুষ্ঠান তো ঠিকঠাক মতো তুলতে হবে। তার উপর আরও একটি চিন্তা এলো মাথায়। হিন্দুরা কেউ যদি না আসে, তাহলে মেলায় দোকানপাটই বা বসাবে কে। আশি ভাগ দোকানপাটই তো হিন্দুদের। মুজিবের মনটাও খারাপ হলো কিছুটা। সে তো কোদিন বন্ধুদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম ভাগ করে নি। হিন্দু বন্ধুদের গলা জড়িয়ে হাঁটে, গান গায়। এক সাথে খেতে বসে। বাংলার এতো বড় দু’ জন মানুষকে  সম্বর্ধনা দেয়া হবে, অথচ কোন হিন্দুরাই সেখানে থাকবে না! 
শেষে দেখা গেলো- নমশূদ্র শ্রেণীর সব হিন্দুরাই এসে যোগ দিলো মুসলমাদের সাথে। কারণ, মন্ত্রী মুকুন্দবিহারী মল্লিক আসবেন হক সাহেবের সাথে। গোটা গোপাগঞ্জ জুড়েই নানা রকম গুজব আর উত্তেজনা। কখন যেন কি হয়। গ্রাম থেকে দলে দলে মুসলমানরা সব এসে জড়ো হলো গোপালগঞ্জ শহরে। হিন্দুরা যদি কিছু বলে তাহলে তা প্রতিহত করতেই হবে। সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গার ভয় উঠলো মানুষের মনে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন রকম দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছাড়াই সব কাজ শেষ হলো। মেলা উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী আর শ্রমমন্ত্রী। তার পর সভা হলো। সভা শেষ করেই প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক গেলেন পাবলিক হল দেখতে। আর শহীদ সোহরাওয়ার্দী গেলেন মিশন স্কুল দেখতে। স্কুলের পক্ষ থেকেও তাকে সম্বর্ধনা দেয়া হলো। 
স্কুল ভিজিট করেই লঞ্চঘাটের দিকে হাঁটতে থাকেন সোহরাওয়ার্দী সাহবে। তার পাশেপাশে হাঁটে মুজিব। অন্য সব ভলান্টিয়ার ছেলেরা একটু পিছনে। ভাগ হয়ে কেউ কেউ আবার চলে গেছে পাবলিক হলের দিকে। 
সোহরাওয়ার্দী জিগ্যেস করলেন,‘ তোমার নাম কি?’
‘মুজিব, শেখ মুজিবুর রহমান।’
‘ কোন স্কুলে লেখাপাড়া করো?’
‘ মিশন স্কুলে-’
‘ বাড়ি কোথায়?’
‘ টুঙ্গিপাড়া-’
‘ তোমার বাবা কি করেন?’
‘ কোর্টের শেরেস্তাদার।’
‘ তার নাম কি?’
‘ শেখ লুৎফর রহমান।’
‘ ভাল।’ একটু থেমে সোহরাওয়ার্দী আবার জিগ্যেস করলেন,‘ তোমাদের এখানে কি মুসলিমলীগের কোন কমিটি  করা হয় নাই?’
‘ জ্বি না। কোন প্রতিষ্ঠান নাই। মুসলিম ছাত্রলীগও নাই।’
পকেট থেকে একটি নোটবুক বের করলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তার পর মুজিবের নাম ঠিকানা ভাল করে লিখে নিয়ে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন। আর মুজিবেকে বললেন,‘ তুমি কলকাতায় এলে আমার সাথে দেখা করবা।’
ডান দিকে মাথা হেলায় মুজিব। তার পর হাসি মুখে বলে,‘ জ্বি আচ্ছা। ’
তার ক’দিন পরেই কলকাতা থেকে একটি চিঠি এলো মুজিবের নামে। লিখেছেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। চিঠি পেয়ে তো মুজিব মহাখুশি। দেশের নাম করা এতো বড় একজন তাকে চিঠি দিয়েছেন। মুজিবও চিঠির উত্তর দিতে থাকে। চিঠিতেই যোগাযোগ শুরু হলো সোহরাওয়ার্দীর সাহেবের সাথে। তার সাথে দেখা করার খুবই ইচ্ছে জাগে মুজিবের মনে। কিন্তু কলকাতা আর যাওয়ার সুযোগ হয় না ওর। 
১৯৩৯ সাল। গোপালগঞ্জ শহরের গলিঘুঁজিতেও একটি গুনজন শোনা যাচ্ছে। মুসলিমলীগ ও মুসলিমছাত্রলীগের কমেটি গঠন করা হবে। এদিকেকংগ্রেসের হিন্দু নেতারা মুসলিমলীগ গঠনে ঘোর বিরোধী। কিন্তু হঠাৎ করে গোপলগঞ্জে মুসলিমলীগই বা কেন মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াবে? শহীদ সাহেব আর হক সাহেব আসার পর থেকেই মুসলিমলীগের কথা শোনা যাচ্ছিল দুচার জনের মুখে। কিন্তু এখন কার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ গঠন হচ্ছে, তা বুঝতে পারছে না কংগ্রেসের নেতারা। 
এর মধ্যে কলকাতায় বেড়াতে যায় মুজিব, তার মেঝ বোনের বাসায়। মূল উদ্দেশ্য ছিল সোহরাওয়ার্দীর সাথে দেখা করা। সোহরাওয়ার্দীর সাথে দেখাও হলো মুজিবের। সেখান বসেই ছাত্রদের নেতা আবদুল ওয়াসেকের সাথেও পরিচয় হয়। নানা কথার ফাঁকে সোহরাওয়ার্দী বললেন,‘ গোপালগঞ্জে মুসলিমলীগ আর মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করা হবে।’
মুসলিম লীগের কমিটি গঠনের সব রকম দায়িত্ব পড়ে মুজিবের উপর। কংগ্রেস নেতারও মুজিবের নাম শুনে কিছুটা চুপশে যায়। মুসলিম ছাত্রলীগের কমিটি করা হলো। সভাপতি- খন্দকার শামসুদ্দীন, আর সম্পাদক করা হলো- শেখ মুজিবুর রহমান। মুসলিম লীগও গঠন হলো। তাছাড়া মুসলিমলীগ ডিফেন্স কমিটিও গঠন হলো। সে কমিটির সেক্রেটারিও করা হলো মুজিবকে। 
চৈত্র মাসের গরম। বৃষ্টি নেই। মাঠঘাট শুকিয়ে চিড় ধরেছে আঁকাবাঁকা রেখার মতো। শস্য খেতের অবিরাম সবুজ চোখে পড়ে না। মরা শুকনো খড়কুটো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মাঠে মাঠে। কদিন পরেই মুজিবের বোর্ড পরিক্ষা। কিন্তু প্রথম পরীক্ষার দিনই জ্বরে একেবারে বিছানা ধরা মুজিব। সারা রাত লুৎফর রহমান মুজিবের মাথার কাছে বসা। তবুও সকালে পরীক্ষার দিতে গিয়েছিল চলে গেলো মুজিব। জ্বর নিয়ে পরীক্ষা তেমন ভাল হলো না। অন্য সব সাবজেক্টে সেকেন্ট ডিভিশন ছিল। ওই প্রথম বাংলা পরীক্ষাটা খরাপ হলো। সামনের বারে পরীক্ষা দিলে ঠিকই পাস করে যাবে। 
কিন্তু অনেকেই বলে- আর কি পড়ালেখা হবে। যে ভাবে রাজনীতিতে জড়াচ্ছে। কলকাতায় যায়। মাদারীপুর, ফরিদপুর গিয়ে মুসলিম ছাত্রলীগের কমিটি করে। মুসলিম লীগের সামনে একটাই চাওয়া। যে করেই হোক মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান আনতে হবে। কংগ্রেসের মধ্যে হিন্দুদের দাপট মুসলমানরা আর কতো দিন তা সহ্য করবে। মুসলিম লীগের পক্ষে দিন রাত কাজ করে মুজিব। সভায় বক্তৃতা দেয়া শিখে গেছে। কণ্ঠের জোর শুনে মানুষ অবাক হয়। ‘ আজাদ’ পত্রিকা পড়ে। পাকিন্তান না হলে মুসলমানেদের দুঃক্ষের কোন সীমা থাকবে না। 
একদিন লুৎফর রহমান বললেন,‘ তুমি রাজনীতি করছ, করো। তাতে আমার কোন অভিযোগ নেই। কিন্তু পড়ালেখাটা চালিয়ে যেতে হবে।’
মুজিবও পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে। সময় পেলেই সে পড়তে বসে। মেট্রিক পরীক্ষাটাও দিলো এবছর। রেজাল্ট খারাপ হয় নি। সেকেন্ট ডিভিশনে পাশ করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে গিয়ে ভর্তি হলো। কিন্তু কোথায় থাকবে। তা নিয়ে বিশাল ঝক্কির মধ্যে পড়তে হলো। শেষ পর্যন্ত লুৎফর রহমান ঠিক করলেন, মুজিবকে রাখা হবে বেকার হোস্টেলে। 

0 comments:

Post a Comment