নিহত ঘুম
আবুল ফজল
লোকে নাকি ঘুমের বড়ি খায়। ঘুম আসে না চোখে। সারাদিন ঘোরাঘুরি আর খেলাধুলা করেও নাকি ওরা ঘুমাতে পারে না। এমন কি তরুণ বয়সের ছাত্রছাত্রীদের অনেকের নাকি শুতে যাওয়ার আগে খুব কড়া ঘুমের বড়ি খেতে হয়।
কতবারই তো ডাক্তারের সঙ্গে কনসাল্ট করলাম। তাঁরা শুধু বলেন: আমরা শুধু ঘুমের ওষুধ দিতে পারি, ঘুম তো দিতে পারি না। মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে বলেন: চান তো দিতে পারি চিরঘুমের ওষুধ। ভাবি তাই দেবো নাকি! ডাক্তার ছাড়াই তো তা করা যায়। কত উপায় আছে! এজন্যে ডাক্তারের দরকারটা কি! একটা দড়িই তো যথেষ্ট। চোখ বুঁজলে ঘুম একটু এলেও মুহূর্তে যে বিভীষিকাময় স্বপ্ন নেমে আসে তাতে ঘুম পগার পার।
ভালো পাশ করতে পারিনি। গৃহস্থ ঘরের ছেলে, ভাত-কাপড়ের অভাব ছিল না। শরীরটা তাই তাগড়া ছিল। আই.এ. ফেল, অন্য চাকরি জোটার সম্ভাবনা কম। কপাল ঠুকে তাই ঢুকে পড়লাম আর্মিতে। নির্বাচনের সময় সব রকম টেস্টেই পয়লা নম্বর। খাতার পরীক্ষায় ফেল করলে কি হবে, দেহের পরীক্ষায় খাতার পয়লা নম্বরকেও ছাড়িয়ে গেলাম আমি।
বুক চিতিয়ে বন্ধুদের জানালাম সাফল্যের কথঅ। কলেজ ছেড়ে আসার দিন মাষ্টারদের দিকে ফিরেও তাকালাম না একবার। সহপাঠীদের কয়েকজন মিলে আবু তালেবের ক্যান্টিনে ঘটা করে একটি পার্টিও দিয়ে দিলো। কেউ কেউ উচ্ছ্বাসের বশে সেদিন বক্তৃতার সুরে বলেই ফেললো: হে দেশরক্ষার বীর সৈনিক, তোমার সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও বুক গৌরবে ফুলে উঠছে। ...এ ধরনের সব বক্তৃতা।
দু’একদিনের মধ্যেই শুরু হলো কঠোর সৈনিক জীবন। কঠোর হলেও আরামে আছি বলতে হবেÑ খাই দাই, সকালে দলের সঙ্গে তিন মাইল দৌড়াই, কুচকাওয়াজ করি, বিকেলে খেলাধুলো। খাদ্য-তালিকায় গোস্ত-পরোটা-ফলফলারি তো আছেই। তাগড়া শরীর দেখতে দেখতে আরো তাগড়া হয়ে উঠলো।
চাঁদমারি প্রাকটিস করতে করতে হাত ঠিক হয়ে গেছে। লক্ষ্যভেদে ভুল হয় না। লড়াই দুরস্ত। লড়াই তো আর কথায় কথায় বাধে না। দেশরক্ষার যুদ্ধে শহিদ হওয়ার সুযোগ অনেকের সারা জীবনেও মেলে না। এজন্যে কেউ অবশ্য আফসোস করে না।
য়ূনিফরম পরে রাইফেল কাঁধে যখন লেফঠ-রাইট করে কুচকাওয়াজ করি, কিংবা সময় সময় যখন রুট মার্চ করি তখন একটা শহিদি ভাব মনে মনে বোধ করে থাকি। চলাফেরায় চলনে-বলনে সে ভাবটা হরহামেশাই ফুটে ওঠে।
সকাল-বিকেলে ভালো খাওয়া-দাওয়া, নিয়মিত প্যারেড আর বিকেলে খেলাধুলার পর বিছানায় পড়তে না পড়তেই ঘুমে ঢলে পড়তাম। আমার জীবন থেকে সেসব দিন এখন হারিয়ে গেছে।
হঠাৎ ইতিহাসের তো বটেই আমার জীবনেও ঘটে গেল এক অঘটন। মোড় ফিরে গেলো দেশের এবং আমার জীবনেরও। আমি তো স্রেফ নিমিত্তের ভাগী। কোন ষড়যন্ত্রের খবর আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। ফরিদ, হামিদ প্রভৃতি মেজরদের পাল্লায় পড়ে ভোররাত্রে আমাকেও য়ূনিফরম পরে রাইফেল কাঁধে দলে ভিড়ে পড়তে হয়েছিল। জানেনই তো সিপাই মাত্রেই হুকুমের দাস। যে এক ধাপ উপরে সেও হুকুম চালাতে পারে। সেও হুকুমের মালিক।
সিপাইর প্রথম সবক ও শপথ: উপরওয়ালার হুকুম তামিল করা। এর সামান্যতম খেলাপেও কোর্ট মার্শাল হতে পারে যে কারোর।
ভদ্রতার খাতিরে সামাজিক কথাটা ব্যবহার করা হলেও আসলে মানুষও যূথবন্ধ জীব। সিপাইদের পেশাই বাধ্য করে তা হতে।
সেদিন অসমাপ্ত ঘুম থেকে জেগে উঠে উদভ্রান্তের মতো দলের সঙ্গে ট্যাঙ্কের ঘর ঘর আওয়াজ আর রাইফেল-মেশিনগানের অবিরাম শব্দের ধুম-ধারাক্কার মাঝখানে আমিও দলে ভিড়ে এক ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম। হয়তো সেই চরম উত্তেজনার মুহূর্তে আমি ভুলে বসেছিলাম নিজেকে। স্রেফ মনে ছিল আমি সৈনিক, হুকুম তামিলই আমার ধর্ম, আমার পেশা। আমার মরা-বাঁচা নির্ভর করে হুকুম তামিলের ওপর।
অনবরত হুকুম হচ্ছিল- গুলি করো, ফায়ার, ফায়ার। কারো মুখের দিকে তাকিয়ো না। ফায়ার। এক শালপ্রাংশুদেহ পুরুষ, চিরপরিচিত পাইপ হাতে নির্ভীক পদক্ষেপে নেমে আসছিল সিঁড়ি বেয়ে। একজন পিছন দিক থেকে চেঁচিয়ে ফায়ার বলতে না বলতেই কে বা কারা ঐ শালপ্রাংশুদেহের প্রশস্ত বক্ষ-লক্ষ্য করে গুলির পর গুলি ছুঁড়তে শুরু করলো। শালগাছের মতো বিরাট দেহ সিঁড়ির ওপরই পড়ে গেল সটান।
তারপর গুলি ছোঁড়ার সে কি তাণ্ডবলীলা। কানে এলো একটা বালক-কণ্ঠের কান্নায় ভেঙে পড়া করুণ মিনতি: আমাকে মেরো না, আমাকে মেরো না। এ ঘরে আমি আর কোনোদিন আসবো না, আসবো না। তোমাদের পায়ে....। কথাটা শেষ হতে পারলো না। দ্রুম শব্দের সঙ্গে সঙ্গে তার রক্তাক্ত কচি দেহ আমার সামনেই গড়িয়ে পড়লো।
এক অনুপম স্বাস্থ্যবর্তী তরুণী আলুথালু বেশে ছুটে এসে কাকুতি করে বললো: আমি তো এ বাড়ির মেয়ে নই। এই দ্যাখো মাত্র এক মাস আগে আমার বিয়ে হয়েছে। অমন রক্তঝরা পাইকারি হত্যার রক্তাক্ত মুহূর্তে ওর মেহেদিরাঙা হাত দুখানা সে তুলে ধরলো। পাষাণ গললো না। গুলিবিদ্ধ হয়ে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই ওর অনুপম তন্বী দেহটা গড়িয়ে পড়লো মেঝের ওপর। ছেলে মেয়ে ঝি বধূ তরুণ তরুণীর রক্ত সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। এমন রক্তস্রোত কোরবানির দিনেও আমি দেখি না। বাথরুম, পায়খানা, রান্নাঘর সর্বত্র ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে তাজা সদ্যমৃত রক্তাক্ত লাশ।
দোতলার বারান্দার এক কোণায় ঝুলন্ত খাঁচায় পাখা ঝাপটাচ্ছিল এক পোষা ময়না বুঝি- বাড়ির ছেলে- মেয়ে আর ঝি-চাকরেরা দীর্ঘদিন ধরে বহু কসরতে তালিম দিয়ে ওকে বোধ করি শিখিয়েছিল, কিচির-মিচির করতে করতে হঠাৎ আর্তস্বরে ডেকে উঠলো ‘বঙ্গ...’। শেখানো বুলিটা শেষ করার আগেই আমাদের মধ্যে ঐদিন যে একমাত্র বীরোত্তম ছিল, সে সঙ্গে সঙ্গে খাঁচা লক্ষ্য করে গুলি করে দিলো। খাঁচা চিরদিনের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেল। ‘বন্ধু’ আর উচ্চারিত হতে পারলো না পাখির শেখানো মুখ থেকে।
কোরবানির দিনে জবাই করা গরুর রক্তও বুট পায়ে এভাবে আমরা মাড়াই না। অন্তত আমি কোনোদিন মাড়াইনি। এতো মানুষের তাজা রক্ত। মেয়ে-পুরুষ আর শিশুর রক্ত মাড়িয়ে আমরা বীরত্বের সঙ্গে নিচে নেমে এলাম। দেখলাম ভীতসন্ত্রস্ত এক মুরগি উঠোনের এক কোণে গাছতলায় দেয়াল ঘেঁষে নিজের কচি বাচ্চাদের দু’পায়ে ঢেকে শঙ্কিত চোখে চেয়ে আছে। বন্দুক হাতে আমাদের বীর মূর্তি দেখে আরো যেন কুঁকড়ে গেল। আমাদের কে একজনের যেন সজাগ দৃষ্টি পড়লো ওর ওপর, হাতের সুখেই বোধ করি ওকে লক্ষ্য করে ছুঁড়লো রাইফেলের গুলি। মুরগি-জননীর ঠোঁট বেয়ে রক্ত বেরুল অঝোরে আর বেরুলো একটিমাত্র কক্ শব্দ। তারপর ঢলে পড়লো বাচ্চাদের ওপর। ভয়ার্ত বাচ্চারা ইতস্তত ছুটছিল। কেউ কেউ ওদের তাক করে রাইফেল তুললে আমাদের মেজর দয়াপরবশ হয়ে হাত তুলে নিষেধ করলেন: আর নয়, অনেক হয়েছে, আমাদের কাজ ফতে!
মানুষের এ দুনিয়ায় দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধ নাকি হয়ে গেছে। আমি তা দেখি নি। প্রথমটার সময় আমার জন্ম হয়নি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমি শিশু। শুনেছি এ দুই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, হয়েছে পঙ্গু বিকলাঙ্গ। আমাদের গৌরব আমরা কাকেও পঙ্গু বা বিকলাঙ্গ হয়ে, অপরের মোহতাজ হয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ দেইনি। সে যুদ্ধের সময় দুই পক্ষের হাতে শুধু বন্ধু-রাইফেল নয়, বোমা-কামানও ছিল, ছিল আরো কত রকমের হাতিয়ার। আমরাও কি তেমন এক যুদ্ধ জয় করে এলাম! আমাদের সেনাপতি বলেছেন আমাদের কাজ ফতে, অর্থাৎ আমরা বিজয়ী। কিন্তু যাদের আমরা মেরেছি তাদের হাতে তো কোন অস্ত্র ছিল না। ঠাণ্ডা রক্তে হত্যা করা সৈনিকের ধর্ম নয়, ট্রেনিং-এর সময়মনে হয় এরকম একটা পাঠ আমাদের শেখানো হয়েছিল। যে বালকের মৃতদেহ এখনো জোড়হাত করা অবস্থায় খাটের কাছে পড়ে আছে তার হাতে তো একটা খেলনা- বন্দুকও ছিল না, ওর চোখে তখনো ঘুমের পিচুটি। সে এখনো শেখেনি কি করে বন্দুকে গুলি ভরতে হয়। মেহেদি-রাঙা হাতেও তো কোনো হাতিয়ার ছিল না। চোখে ছিল শুধু মিনতি, বাঁচার আকুতি।
আমার বিয়ে হয়েছে মাত্র অল্পদিন। এখনো ছেলেপিলে হয়নি। কিন্তু বড় ভাই আর বোনদের ছেলে-মেয়ে রয়েছে। আমি বাড়ি গেলে ওরা আমাকে চেপে ধরে। ছুটে এসে আমার কোলে-কাঁধে চড়ে বসে। এদের কারো কারো বয়স, যে নিহত রক্তাক্ত বালকটির মৃতদেহ ডিঙিয়ে নিচে নেমে এসেছিলাম সেদিন, তার চেয়ে বেশি নয়। এদের কাকেও যদি কেউ হত্যা করে, তাকে আমি মানা করতে পারবো? না পারবো বীর বলতে, না পারবো বলতে দেশপ্রেমিক? প্রাণের চেয়ে বড়, শিশুর চেয়ে প্রিয় আর কি আছে।
বিয়ের পর নতুন বৌকে নিয়ে যখন বাড়ি আসি রাত্রে ভাবি আমাদের দু’জনকে বাসর ঘরে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইর থেকে দরজার খিল দিয়ে দিয়েছিল। সেদিন বৌয়ের মুখ থেকেও তার মেহেদিরাঙা হাত দু’খানাই আমার কাছে অপূর্ব আর অতুলনীয় মনে হয়েছিল। চুমোর পর চুমো দিয়ে সে হাত দুখানাকে যে কিভাবে ভরে দিয়েছিলাম সেদিন তা মনে পড়লে আমি আজো পুলকে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি।
১৫ই আগস্টের সেই ভয়াবহ ভোররাত্রির কথা মনে হলে আমার দেহ শিউরে ওঠে। সেই মেহেদি-রাঙা হাত দু’খানার কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না। তখন আমি আর আমি থাকি না। হয়তো থাকি না মানুষও।
আজ প্রায় এক বছরের বেশি হতে চললো, তবুও রাত্রে বিছানায় শুয়ে চোখ বুজলেই আমার চোখের সামনে সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য একের পর এক ভেসে ওঠে। এত চেষ্টা করি ঘুমাতে পারি না, ঘুম এলেই সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য একের পর এক ভেসে ওঠে। সারা রাত আর ঘুমই আসে না। ঘুমের কড়া কড়া ওষুধ খাই, কোন ফল হয় না। ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন দিয়েও দেখেছে, ঘুম আসতে চায়, আসেও, কিন্তু ইনজেকশনেও সে বিভীষিকাময় স্বপ্নের হাত থেকে রেহাই পাই না। ফলে ঘুম যায় ছুটে, সারা রাত কাটাতে হয় বিনিদ্র। ডাক্তার বলে ইনসমনিয়া-মেডিক্যাল শাস্ত্রে যাই নাম থাকুক, তার ওষুধ থাকবে না কেন?
ডাক্তার একবার নিম্নস্বরে বলেছিলেন, কিছু কিছু পান করে না হয় দেখুন। ডাক্তারের পরামর্শে তাও ট্রাই করে দেখেছি। মাত্র বাড়িয়েও দেখেছি, কিন্তু ঘুম আসে না। যা আসে তা সে বিভীষিকাময় রক্তাক্ত ভোর-রাত্রির দৃশ্য। অনেকে পরামর্শ দেন ‘খেয়েই শুয়ে পড়বেন, চোখ বুঁজে পড়ে থাকবেন, এক সময় ঘুম আসবেই।’ চোখ বুঁজলেই তো সেই ভয়াবহ দৃশ্য, ঘুম বলতে যা বোঝায় তা আমার চোখের ত্রিসীমানা থেকে পলাকত।
দিনশেষে রাত ঘনিয়ে এলেই আমার ভিতরে শুরু হয়ে যায় আতঙ্ক। কি করে নিদ্রাহীন রাত কাটাবো এ ভয় কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারি না।
কারবালা আমি স্বচক্ষে দেখিনি। মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু দিয়েই কারবালার সঙ্গে আমার পরিচয়। সেটা পড়ে কিশোর বয়সেও আমি চোখের পানি রুখতে পারিনি।
১৫ আগস্ট আমরা নিজেরাই সৃষ্টি করেছি দ্বিতীয় কারবালা। আমরা এ কারবালার এক-একজন নায়ক। এ কারবালাকে নিয়ে কেউ কি একদিন দ্বিতীয় বিষাদ সিন্ধু লিখবে না? এযুগে মশাররফ হোসেন জন্মে কাজ নেই। খামাখা জেলে গিয়ে কি লাভ? যুগটাই যে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার যুগ। তবু আমার বিশ্বাস লেখা একদিন হবেই।
এজিদের সৈন্যরা মেয়েমানুষের কিংবা নিরীহ পাখ-পাখালির গায়ে হাত তুলেছিল, তাদের হত্যা করেছিল- মোশাররফ হোসেন তাঁর বিষাদ সিন্ধুতে তেমন কথা লেখেননি। আমরা তাদের চেয়ে বড় বীর। ইতিহাস আমাদেরকে তাদের চেয়ে বড় শিরোপা দেবে- সেদিন মনে মনে এ শ্লাঘাও বোধ করেছিলাম আমরা। নিজেদের সাফল্যে নিজেরাও খুব করে হেসেছিলাম ব্যারাকে ফিরে গিয়ে।
নিজেদের মিইয়ে আসা উৎসাহ আর উত্তেজনাটাকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য মেসে এসে গ্লাসের পর গ্লাস গিলেছি। দিনের বেলাটাও কাটলো এভাবে হৈ-হুল্লাড় করে।
রাত্রে যখন ঘুমুতে গেলাম চোখ বন্ধ করতেই সবটা দৃশ্য চোখের সামনে ছায়াছবির মতো এমনভাবে ভেসে উঠল যে সারারাত এক-ফোঁটা ঘুম এলো না চোখে। বিনিদ্ররাত কাটাবার পর দিনের আলোয় মনে হলো আমার চোখের ঘুমটাকে আমিই যেন হত্যা করেছি। আমার রাইফেল যাদের প্রতি উদ্যত হয়েছিল তারাসবাই আজ চিরনিদ্রায় নিদ্রিত। অথচ আমি.... সেই ভয়াবহ রাত্রির পর থেকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসতেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি, হয়তো ঘুম আসবে না, ঘুমোতেই পারবো না সারা রাত এমন একটা আতঙ্ক পেয়ে বসতো।
সত্যই এ ভাবেই চলতে লাগলো রাতের পর রাত। এখন নিশ্চিন্তভাবে বুঝতে পারছি আমিই আমার ঘুমের হন্তা। খুন করেছি নিজের চোখের ঘুমকে নিজের হাতে। অশরীরী ঘুমকেও যে এককভাবে হত্যা করা যায় তা আমার জানা ছিল না আগে। একটা বৃহৎ জ্ঞঅন যেন আমার চোখের সামনে উন্মোচিত হলো- হত্যা শুধু নিহতকে হত্যা করে না, হত্যাকারীকেও করে। অন্য কিছু বোধ হয় এভাবে বুমেরাং হয় না। ভাবতে ভাবতে এক পরম সত্যের দুয়ার যেন আমার চোখের সামনে খুলে গেল।
সে থেকেই আমার এ দশা। শুনেছি জলাতংকে রোগী জল দেখলেই আতঙ্গে কাঁপতে থাকে, ছুঁড়তে থাকে হাত-পা, ঝাঁপ দিয়ে পড়তে চায় জলে। ঘুমাতঙ্ক বলে কি কোন রোগ আছে? যে রোগে আমি আক্রান্ত? তা না হলে বিছানায় শুতে যাওয়ার সময় আমি এমন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি কেন? সারা রাত একফোঁটাও আমি ঘুমুতে পারবো না কেন? চোখ বন্ধ করে ঘুমোবার চেষ্টা করতেই কেন এত সব বিচিত্র বিভীষিকাময় চিত্র আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে? সারাটা রাত কেন আমাকে ছট্ফট্ করে কাটাতে হয়? হাঁ, আমি ঘুম- ঘাতক, নিজেই নিজের নিদ্রাহন্তা।
তখনো বত্রিশ নম্বর বাড়ির সবাই জেগে ওঠেনি। কাউকে ঘুমন্ত অবস্থায়ও গুলি করা হয়েছে। কে কাকে করেছে বলতে পারবো না, তবে আমিও তো ঔ দলে ছিলাম। তাতেই কি আমি এ অদ্ভুত ঘুমাতঙ্ক রোগে ভুগছি? এর কি কোন ওষুধ নেই? ডাক্তার কবিরাজ হেকিম সবাই জবাব দিয়েছে। একটার পর একটা ওষুধ বদলিয়ে তারা ফেল করেছে। আমি ঘুমাতে চাই, চাই গভীর ঘুমে মগ্ন থাকতে। কিন্তু ঘুমের তো কোন দোষ নেই, ঘুম আসতে না আসতে যত সব ভয়াবহ দৃশ্যই তো ঘুমকে চোখ-ছাড়া করে। সেসব রক্তাক্ত ভয়াবহ দৃশ্য দর্শনে তন্দ্রাবস্থায় আমার সর্বশরীর যে ভাবে কাঁপতে থাকে তাতে ঘুম আসার কথা নয়।
এক ডাক্তার তো বলেই দিয়েছে: ঘুমই ঘুমের একমাত্র দাওয়াই। সে ঘুম আমার চোখ-ছাড়া।
কোথায় পাবো ঘুম?
দীর্ঘ ছুটি নিয়ে বাড়ি এলে আব্বা ডেকে নিয়ে এলেন দেশের এক ডাকসাইটে কবিরাজকে। সে কবিরাজ পরামর্শ দিলেন মাথার তালুর চুল চেঁচে তাতে সব সময় এক দলা মাখন দিয়ে রাখতে, শোয়ার সময়ও। তাও করে দেখেছি। কিন্তু কিছুতে কিছু হয় না। চোখ বুঁজলেই সে ভয়াবহ দৃশ্য.......।
পাশে বৌকে অকাতরে ঘুমুতে দেখে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে গলা টিপে ওকে মেরে ফেলি, যেমন করে মেরে ফেলেছি আমার দু’চোখের ঘুমকে।
একদিন খান কয়েক কাপড় পুরোনো সংবাদপত্র দিয়ে মুড়ে নিয়ে আব্বা-আম্মাকে বল্লাম: আমি ঘুমের সন্ধানে চল্লাম, ফকির-দরবেশের দরগা আর আস্তানায় গিয়ে দেখি। নানা জেলা থেকে নানা মকসুদে কত লোকই তো আসে ‘শাহ আমানত’ আর ‘বায়জিদ বোস্তামে’- আর যেসব দরগা রয়েছে আমাদের এ বারো আউলিয়ার দেশে। ফকির-দরবেশের নাম শুনে আব্বা তেমন আপত্তি করলেননা। আম্মা আর বৌ অঝোরে কাঁদতে লাগলো। মন স্থির করে ফেলেছি। সব কিছু অগ্রাহ্য করে, আব্বা-আম্মার পায়ের ধুলো নিয়ে, বিড়বিড় করে ‘ঘুম ঘুম’ করতে করতে আমি বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে, যে ঘরে আমার জন্ম, যে ঘরে কেটেছে একটানা আমার শৈশব-কৈশোর সে ঘর থেকে, যে ঘরে অকাতরে ঘুমিয়েছি রাতের পর রাত।
পুনশ্চ: প্রায় মাসখানেক পরে কে একজন ওদের বাড়িতে এসে খবর দিলো, কর্ণফুলিতে একটা লাশ ভেসে এসে কালুরঘাটের পোলের থামে লেগে রয়েছে। ছেলে ঐভাবে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর অনেক কথাই বাপের মনে আনাগোনা করছিলো। ছেলের আপদ-বালাই দূর হওয়ার নিয়তে মা ছদকা দিয়েছেন মুরগি আর বাপ দিয়েছেন ছাগল। এ খবর পাওয়ার পর ওর বুড়ো বাপ আলতাফ মুন্সি লোকজন নিয়ে ছুটে এসে লাশ উদ্ধার করে চিনতে পারলো। পাড়ে এনে শুইয়ে রাখলো খাটিয়ায় তোলার জন্যে। ওর বাপের মুখে শুধু একটি কথাই কলমার মতো বিড়বিড় করে উচ্চারিত হলো: ঘুমা, ঘুমা বাছা।
0 comments:
Post a Comment