Monday, July 27, 2020

ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নতুন দেশের অভ্যুদয়বার্তা , প্রবন্ধ ( মোঃ মুজিবর রহমান)




ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নতুন দেশের অভ্যুদয়বার্তা
 মোঃ মুজিবর রহমান
আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বাঙালির জাতীয় জীবনে অবিস্মরণীয় দিন। মহাকালের কাল-পরিক্রমায় ঘুরে আবার ফিরে এসেছে সেই দিনটি। এবার বাঙালির জীবনে ৭ মার্চ এসেছে  একটু ভিন্নমাত্রা নিয়ে। আজীবন লড়াই সংগ্রামে আপোষহীন নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের জাতীয় জীবনের অমূল্য সম্পদ ও অন্তহীন প্রেরণা। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততোদিন এ ভাষণের চেতনা ও আদর্শ আমাদের সকলের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে এ দেশের প্রশাসন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশই চলেছে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ৭ মার্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এ ভাষণটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠতম ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর এ অলিখিত ভাষণটি ছিলো খুবই সাজানো ও প্রাণবন্ত। আবার রাষ্ট্রনায়কসুলভ অভিব্যক্তি এতে প্রকাশ পেয়েছে। আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্বাধীনতা ও যুদ্ধের প্রস্তুতির ডাক দিয়েছিলেন। বিশ্বে এ ভাষণ গুরুত্বপূর্ণ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ভাষণ হিসেবে বিধৃত। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সেটিসবার্গ ভাষণ যেমন গণতন্ত্রের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। তেমনিভাবে ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। যুগে যুগে সকল নির্যাতিত মানুষের কাছে স্বাধীনতার মন্ত্রতুল্য বলে বিবেচিত হবে। আব্রাহাম লিংকন বক্তৃতা করেছেন আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে। বঙ্গবন্ধু করেছেন স্বাধীনতা লাভের পটভূমিতে। লিংকনের ভাষণের একটি লিখিত রূপ ছিলো। অপরদিকে বঙ্গবন্ধুর ১৯ মিনিটের ভাষণ লিখিত ছিলো না। আব্রাহাম লিংকনের ভাষণের শব্দসংখ্যা ছিলো মাত্র ২৭২ টি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের শব্দসংখ্যা ছিলো ১১০৭ টি। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, আব্রাহাম লিংকন ভাষণ দিয়েছেন আমেরিকার স্বাধীনতা লাভের অনেক পরে। তখন তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছেন বাঙালি জাতির মহান নেতা হিসেবে। একাত্তরের ৭ মার্চ ঢাকা শহর ছিলো মিছিলের শহর। মিছিলো আর মিছিলো। সব মিছিলেই এসে থমকে দাঁড়ায় রেসকোর্স ময়দানে। রেসকোর্স ময়দান রূপ নেয় জনসমুদ্রে। বাঁশের লাঠির সঙ্গে লাখো কণ্ঠের স্লোগান কেঁপে ওঠে সেদিনের ঢাকা শহর। বাতাসে উড়ে সবুজ জমিনে বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা। বিকেল ৩ টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালোকোট পরে বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু দৃপ্ত পায়ে উঠে এলেন মঞ্চে। স্লোগান আর মহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানালেন অপেক্ষমাণ জনসমুদ্রকে। তারপর শুরু করলেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ। রেসকোর্স ময়দানের এই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে ডাক দেন, সেই ডাকেই বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। 
২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী নৃশংস গণহত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এদিকে গোটা জাতি ছিলো প্রস্তুত, ৭ মার্চের ভাষণের দিক-নির্দেশনা জাতির সামনে স্পষ্ট, যা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলো এভাবে, ‘ প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে  তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর  মোকাবিলা করতে হবে। ... প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক।’ ভাষণের যেসব অংশে বঙ্গবন্ধুর আদেশ, নির্দেশ, অনুরোধ ছিলো সেগুলো মুক্তিযুদ্ধকালে অগ্নিমন্ত্রের মতো কাজ করেছে। আবার বিশ্ব জনমতের সমর্থন ও কূটনীতির ক্ষেত্রে এই ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত করেছে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহিদের আত্মদান, দুই লাখ মা বোনের সমভ্রমহানি ও সমগ্র বাঙালি জাতির বিশাল ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলেন বহু কাঙ্খিত স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে পাকিস্তানের তেইশ বছরের রাজনৈতিক শোষণ বঞ্চনার ইতিহাস এবং বাঙালির সুস্পষ্ট অবস্থানের চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়ে দ্বন্দের স্বরূপ, অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি তুলে ধরেন। এর প্রেক্ষিতে বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। ভাষণে তিনি প্রতিরোধ সংগ্রামের কলাকৌশল ও শত্রু  মোকাবিলার কায়দা সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা দেন, যা ছিলো এক অপূর্ব ও নাতিদীর্ঘ উপস্থাপনা। এ ভাষণে বাঙালির প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো। তাঁর এই ভাষণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির কথাও উল্লেখ করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার প্রশ্নে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে যাতে চিহ্নিত না হন সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে শত্রুপক্ষকে এমন কোনো সুয়োগ দেওয়া যাবে না যাতে তারা অপ্রস্তুত জনগণের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ করার সুযোগ পেয়ে যায় সে দিকেও নজর রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে। মানুষকে হত্যার প্রসঙ্গে এই ভাষণে বারবার উত্থাপিত হয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এসব ঘটনাকে চিহ্নিত করেছিলেন আমার লোক, আমার মানুষকে হত্যা হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি উক্তিই উদ্ধৃতিযোগ্য ও বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিতে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। জোরালো যুক্তি খুব সহজাত বিশেষত্ব বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব দুঃখী আর্ত মানুষের মধ্যে।’ বঙ্গবন্ধু নিজস্ব ভঙ্গিতে এক পর্যায়ে উচ্চারণ করলেন, ‘আর আমার বুকের ওপর গুলি চালানোর চেষ্টা করবো না। সাত কোটি মানুষের দাবায়ে রাখবার পারবা না। আমরা মরতে শিখেছি, এখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্যে কঠিনের সাথে কোমলের সহাবস্থান ছিলো। এই বৈশিষ্ট্যটি বঙ্গবন্ধুর মাঝে সর্বদাই বিদ্যমান ছিলো। তিনি বড় কঠিনভাবে বললেন, ‘আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব।’ আবার আশ্বাসবাণী হিসেবে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী উদ্দেশে উচ্চারণ করলেন, ‘তোমরা আমার ভাই- তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।’ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে নির্দেশনামূলক কাব্যময় বক্তৃতা প্রদান একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই সম্ভব বিধায় আন্তর্জাতিক সাময়িকী নিউজ উইক একাত্তরের ৫ এপ্রিলে প্রকাশিত তাদের প্রচ্ছদ নিবন্ধে ‘রাজনৈতিক কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলো। এই রাজনৈতিক কবির অমর রচনা হচ্ছে ৭ মার্চের ভাষণ। যা বাঙালির মহাকাব্য। রেসকোর্সের জনসমুদ্র সেদিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবিষ্ট হয়েছিলো সেই বজ্রকণ্ঠে। তাঁর ভাষণের প্রতিটি পঙ্ক্তি যেনো কালজয়ী কবিতার পঙ্ক্তি। এই মহাকাব্য বাঙালি জাতির সংগ্রাম-আন্দোলনের ধারা ও লালিত স্বপ্ন থেকে উৎসারিত। এই মহাকাব্য বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উদ্দীপ্ত ও দীক্ষিত করেছিলো। সাহস, প্রতিজ্ঞা ও স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতির ঘুরে দাঁড়ানোর একটি দিন ছিলো একাত্তরের ৭ মার্চ। বাংলাদেশ নামক দেশটি অবয়ব তৈরির কাজটি করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণে। ৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্র তখন উত্তাল। সময় তখন ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাঙালি যেনো আরও কিছু শুনতে চায়। অবশেষে অবিনশ্বর পঙ্ক্তিটি বঙ্গবন্ধু উচ্চ করলেন, যা শোনার জন্য বাঙালি জাতি উন্মুখ ছিলো, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই ভাষণ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিলো। বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, যখন বাঙালি জাতি পরাধীনতার দীর্ঘ প্রহর শেষে কাঙ্খিত স্বাধীনতার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো তখনই বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির জন্য দিক নির্দেশনা দিয়েছেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে। এ ভাষণের স্তরে স্তরে ছিলো পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয়বার্তা এবং এ দেশে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শাসনের পরিসমাপ্তির ঘোষণা ও বিবরণ। ওই ভাষণে বাঙালি জাতির গন্তব্য নির্ধারণ হয়। তা হলো স্বাধীনতা।

0 comments:

Post a Comment